অদ্বৈত মল্লবর্মনঃ জীবন ও সৃষ্টি


✍️ ----জহরলাল দাস 

অদ্বৈত মল্লবর্মন নামটি উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদসম সেই উপন্যাসটির কথা---" তিতাস একটি নদীর নাম "। অথবা " তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাসটির কথা বললে যার নামটি অবধারিত ভাবে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মন।
বাংলা সাহিত্যের পাঠকমাত্রই জানেন অদ্বৈত মল্লবর্মন ব্রাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার। 
ভারতীয় কর্মবিভাজিত বর্ণভিত্তিক  হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় অন্ত্যজ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোক হিসেবে চিহ্নিত  জলজীবি মালো সম্প্রদায়। জলকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন জীবিকা। জলের মধ্যে জাল ফেলে মৎস্য স্বীকার করেই তারা বংশ পরম্পরায় বেঁচে বর্তে  আছেন  কিংবা থাকেন। আর্থিক ভাবে তো বটেই শিল্প- শিক্ষা- সংস্কৃতি সবদিক দিয়েই পিছিয়ে পড়া এই মৎস্যজীবী, শ্রমজীবী,  মালো সম্প্রদায়ের বাসভূমি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে তিতাস নদী তীরবর্তী গোকর্ণ গ্রামে। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা যাদের গাবরপাড়া বা মালো পাড়া বলে ডাকে । তিতাস পাড়ের সেই মালো সম্প্রদায়ের নদীকেন্দ্রিক জীবন, সংস্কৃতি , সুখদুঃখের বারোমাস্যা নিয়েই অদ্বৈত মল্লবর্মন লিখেছেন এই কালজয়ী উপন্যাস--" তিতাস একটি নদীর নাম "। কেন এই উপন্যাসটির এত জনপ্রিয়তা, লেখকের এই উপন্যাস সৃষ্টির এত দীর্ঘ বছর পরে ও কেন তার এত প্রাসঙ্গিকতা যা অদ্বৈতকে আজও অমরত্ব দান করেছে সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে আমরা দেখে নেব কিংবা জেনে নেবো মহান এই লেখকের জন্ম ও কর্মজীবন এবং পরবর্তী মহান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট।
"তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাসে সমাজের যে জনগোষ্ঠীর জীবন চিত্রের জীবন্ত ছবি অঙ্কন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মন তিনি নিজেও এই সমাজের প্রতিনিধি। আমাদের প্রচলিত বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাত্যজন হিসেবে চিহ্নিত এক দরিদ্র মালো পরিবারে 1914 সালের পয়লা জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের দক্ষিণ- পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে তিতাস নদী তীরবর্তী গোকর্ণ গ্রামে পিতা অধর চন্দ্র মল্লবর্মনের ঘরে অদ্বৈত জন্ম গ্রহণ করেন। অন্য আর দশটি মালো পরিবারের মতো অভাব, দারিদ্র্যতা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলাতেই বাবা মাকে হারান অদ্বৈত। তার পরবর্তী সময় শুধুই কন্টকময় পথচলা। অশিক্ষা, কুশিক্ষা,অভাব, দারিদ্র্যতা  মালোপাড়ার মালো সম্প্রদায়ের পরিচিত দৃশ্য। এমন এক পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মন জীবনের পথচলা শুরু করেন। 
শৈশব থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখা যায় অদ্বৈত মল্লবর্মনের। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, একাগ্রতা , উৎসাহ ও মেধা দেখে গ্রামের কিছু শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তির সাহায্য সহযোগিতায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন অদ্বৈত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রথম মাইনর স্কুলে তাঁর বিদ্যার্থী জীবন শুরু হয়। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। অন্নদা উচ্চবিদ্যালয়ে তাঁর সাহিত্য চর্চা আরো গতিশীল হয়ে উঠে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। 1933 সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন।   কিন্তু পিতৃমাতৃহারা অভিভাবকহীন জীবন এবং অন্যদিকে দারিদ্র্যতা শেষ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রুটি রুজির সন্ধানে জীবিকার খোঁজে কলকাতা শহরে পাড়ি জমান। সেটা 1934 সাল।প্রথমে মাসিক ত্রিপুরা পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে কাজ শুরু করেন।  কিছুদিন কাজ করার পর নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে তখন তিনি কলকাতার বিভিন্ন কাগজে লেখালেখি করতে থাকেন পুরোমাত্রায়। 
নবযুগ পত্রিকা কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। এই পত্রিকাতেই কাজ করার সময় তাঁর ইতিহাস সৃষ্টিকারী উপন্যাস  "তিতাস একটি নদীর নাম " ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ও তিনি "নবযুগ","কৃষক ", "যুগান্তর " ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেন।কিন্তু কোথাও আর স্থায়ী রোজগারের ঠিকানা হয় নি।শেষ পর্যন্ত "দেশ" পত্রিকার  সহকারী সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁকে স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে অকৃতদার অদ্বৈত যা রুজি রোজগার করতেন ইচ্ছে করলে তিনি নিজে স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে পরে চলতে পারতেন। কিন্তু তাঁর এই রোজগার থেকে  নিকটাত্মীয় স্বজন সহ বন্ধু বান্ধবদের ও সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাছাড়া পরিচিতজন কেউ বিপদে আপদে তাঁর সাহায্য প্রার্থী হলে তাদের ও তিনি যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করতেন ।শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজ গোকর্ণ গ্রাম থেকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কাজে যেমন চিকিৎসা, লেখাপড়া ইত্যাদি প্রয়োজনে  কলকাতা শহরে গেলে তারা অদ্বৈতের কলকাতার নারকেলডাঙা অঞ্চলে ষষ্ঠী তলার বাসায় আশ্রয় নিতেন। অদ্বৈত ও তাঁর গ্রামের মানুষদের থাকা খাওয়াসহ, চিকিৎসা ইত্যাদি ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। খুব বড় মনের মানুষ ছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মন।
নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর বাকী অবসর সময় শুধু লেখাপড়া নিয়ে ডুবে থাকতেন। বইকেনা ও বইপড়া তাঁর প্রচন্ড নেশা ।প্রচুর বই কিনতেন। একদিকে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা আর একদিকে প্রচুর বই কেনা ফলে তাঁর হাত প্রায়শই ফাঁকা থাকত।কিন্তু এতে কোন বিচলিত বোধ করতেন না অদ্বৈত মল্লবর্মন।পড়াশোনা আর লেখালেখিই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। কিন্তু তিনি বাস্তব বর্জিত লেখক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী লেখক। তাঁর লেখায় কল্পনা ও রোমান্টিকতার কোন স্থান ছিল না। কলমের কালির তুলিতে তিনি বাস্তবের ছবি আঁকতেন । যা আমরা তাঁর  "তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাসে দেখতে পাই।
লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মন তিতাস নদী ও মানুষের অন্তরাত্মার ছবি এঁকেছেন। তিতাস তাঁর কাছে নিছক একটি নদীই শুধু নয়, তিতাস যেন তাঁর কাছে এক প্রানচন্চল জীবন্ত জলপরি। যার বুকে কান পেতে তিনি শুনেছেন তার বুকে বয়ে যাওয়া জলের গোপন কথা; তার বুকে বসবাসকারী জলজীবি মানুষের মনের গোপন ব্যথা বেদনার কথা। জল ও জীবনকে তিনি এক করে দেখেছেন। অধ্যাপক শান্তনু কায়সার একারনে তিতাস উপন্যাসকে নদী ও মানুষের যুগলবন্দি বলেছেন। সুস্নাত জানা বলেছেন, জেলে জীবনের মহাকাব্য।  সেজন্য  বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে এত নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস থাকা সত্বেও অদ্বৈত মল্লবর্মনের "তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাসটির এত জনপ্রিয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা। এখানেই অন্যান্য নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসিকদের সাথে অদ্বৈত মল্লবর্মনের পার্থক্য। 
" তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাস ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মনের "সাদা হাওয়া", "রাঙামাটি", নামে আরো দুটি উপন্যাস আছে।এগুলিও তৎকালীন সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস।
পূর্বোক্ত তিনটি উপন্যাস ছাড়াও বিভিন্ন ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রে অদ্বৈতের সমাজবোধ ও জীবন ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে "সন্তানিকা", এবং "স্পর্শদোষ" গল্প দুটি জীবনবোধের এক অনবদ্য নিদর্শন। লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতির প্রতি ও অদ্বৈত মল্লবর্মনের সহজাত আকর্ষণ ছিল। 
" তিতাস একটি নদীর নাম " উপন্যাসে লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মন মালো সমাজের জলকেন্দ্রীক জীবন জীবিকা, সমস্যা সংকটের পাশাপাশি অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে তাদের জীবন প্রবাহের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত লোকসংস্কার, লোকরীতিনীতি ইত্যাদি উপস্থাপন করেছেন। জীবন-জীবিকা, সমস্যা-সংকট আচর-আচরন খাওয়া-খাদ্য সংস্কৃতি সবটাকেই লেখক আশ্চর্য দক্ষতার সাথে তুলে ধরছেন। তাছাড়া তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধে লোকসংস্কৃতির নিখুঁত বর্ণাঢ্য সমাহার আমরা দেখতে  
পাই। যেমন-- ত্রিপুরার বারমাসী গান, পল্লীসংগীতে পালাগান, মাঘমন্ডল, বরজের গান, শেওলার পালা, ভাইফোঁটার গান, অপ্রকাশিত পল্লীগীতি, অপ্রকাশিত পুতুলের বিয়ের ছড়া, অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত ইত্যাদি। 
মাত্র 37 বৎসরের জীবনে বিনোদন কিংবা বিলাসিতার কোন স্থান ছিল না অদ্বৈতের ।প্রচন্ড পরিশ্রম ও অনিয়মিত খাওয়া দাওয়ায় ভগ্ন স্বাস্থ্য হয়ে গিয়েছিল অদ্বৈত মল্লবর্মনের। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ছিলেন একেবারেই উদাসীন। দেশ পত্রিকায় কাজ করার সময়ই তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু নিজের অসেচেতনতা ও অবহেলার কারণে দিন দিন এই জটিল ব্যাধি দেহে বিস্তার লাভ করতে থাকে। শেষ অবধি দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ও অন্যান্য বন্ধুরা কাঁচরাপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু এই জটিল ব্যাধি তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত 1951 সালের  16ই এপ্রিল অমিত প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন ।

------জহরলাল দাস 
       খোয়াই, ত্রিপুরা। 
যোগাযোগ--9436539264।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ