নয়ন-তাঁরা

✍️ মৌমিতা সিংহ
প্রাতরাশ সেরে সোফায় বসে খবরের কাগজটা হাতে নিতেই চোখে পড়ল "তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী- তাঁরা ভট্টাচার্য”। হতভম্ব হয়ে গেল নয়ন। প্রায় চল্লিশ বছরের পুরোনো স্মৃতিগুলি যেন আবার জীবন্ত হয়ে কিছু বলতে চাইছে।

তাঁরা তখন এগারো বছরের কিশোরী। একদিন না দেখলেই প্রানটা যেমন দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেত। তেরো বছরের কিশোর নয়ন বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই পৃথা, বল্টু আর অম্বরীষকে নিয়ে তাঁরার বাড়িতে আড্ডা দিতে চলে যেতো।তখন সবার স্কুলেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিলো।তাই সকলে মিলে দিনগুলো খুব মজা করে কাটাচ্ছিলো।পৃথা ছিল নয়নের একমাত্র ছোট বোন। পৃথা আর তাঁরা একই ক্লাসে পড়তো। বল্টু আর অম্বরীষ ছিল নয়নের সবথেকে কাছের বন্ধু। মাঝে মাঝে নয়নের দাদা সোমও তাদের সঙ্গে খেলা আর গল্পের আড্ডায় যোগ দিতো। নয়ন এবং তাঁরা উভয়ের বাবা-ই সরকারী কর্মকর্তা।এই সুবাদেই তাঁরার সাথে নয়নের দেখা।তখন নয়ন পাঁচ বছরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।আর তাঁরা তিন বছরের শিশু কন্যা।ছোট থেকেই একসাথে বড়ো হয় দুজনে এবং দুজনার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। পরবর্তীতে বল্টু আর অম্বরীষের সাথেও তাদের বন্ধুত্ব হয়। বিকেলে তাঁরার হাতে বানানো একগ্লাস সুস্বাদু কাঁঠালেন জুস খেয়ে সকলে মিলে মাঠে চলে যেতো।বিকেলে খেলার জন্য পাওয়া কিছুক্ষণের এই স্বাধীনতাটাই যেন ছিল সারাদিনের একটা অত্যন্ত প্রিয় মুহুর্ত।তারা সকলেই খুব মজা করে কানামাছি, পুতুলের বিয়ে,কাবাডি ইত্যাদি মজার মজার খেলা খেলতো। এভাবেই ছেলেবেলার দিনগুলি ভীষন আনন্দে কাটতে লাগলো।

একদিন সকলে মিলে পরিকল্পনা করলো পুতুলের বিয়ে না দিয়ে নিজেদের মধ্যেই বিয়ে বিয়ে খেলবে। আর যে যার সাধ্যমতো কেউ চাল, কেউ ডাল, কেউ ডিম,কেউ হাঁড়ি ইত্যাদি নিয়ে আসবে। এই ফাঁকে তাদের বহুদিনের একসাথে বনভোজনের ইচ্ছেটাও পূরণ হবে। দিনটি ছিল রবিবার। সকলে মিলে সেদিন সকাল থেকেই লেগে গেল এই বিরাট আয়োজনের জন্য। সবকিছু তৈরী হয়ে গেল। এইবার বিয়ের পালা। এক্ষেত্রে বর নির্বাচিত হলো নয়ন, অপরপক্ষে কন্যা হিসেবে নির্বাচন করা হল তাঁরাকে। আর বাকিরা সকলে ভাগাভাগি করে বরপক্ষ আর কন্যাপক্ষের দায়িত্ব বেছে নিল। খুব ঘটা করে বিয়ে হলো। বিয়ের পরে বনভোজনের অনুষ্ঠানটাও হলো ধুমধাম করে। সেদিন সকলে মিলে ভীষন আনন্দে কাটালো। এই দিনটা ছিল নয়নের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান মুহুর্ত। শুভদৃষ্টি, মালা বদল থেকে শুরু করে বিয়ের সব রীতি মেনেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। সেইদিন খেলার পরে সকলেই যে যার বাড়ি চলে গেলো। কিন্তু নয়ন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁরা চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন যেন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলো। তাঁরাকে ছাড়া নিজেকে যেমন শূন্য মনে হচ্ছিল।সেদিন একটা আলাদা অনুভূতিই মনে বাসা বাঁধ ছিলো। রাতে অনেক চেষ্টা করেও নয়ন ঘুমোতে পারলোনা।চোখ বন্ধ করলেই যেন তাঁরার মায়াবী দুটি চোখ আর মন মাতানো হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পায়। নয়নের জীবনে প্রেম প্রথম বারের মতো কড়া নাড়লো। নয়ন ভালোভাবেই সেটা বুঝতে সক্ষম হলো। পরদিন ভোর হতে না হতেই নয়ন মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়ে পড়লো। ভাবলো যদি তাঁরাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক পলক তাঁরাকে দেখতে পারে।কিন্তু তা আর হলো না।সে বাড়ি এসে নিজের কাজকর্ম সেরে বিকেল টার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।বিকেলে হতে মাত্রই পৃথাকে নিয়ে তাঁরাদের বাড়ি চলে গেলো। যথাসময়ে বল্টু আর অম্বরীষও চলে এলো। প্রতি দিনের মতো তাঁরার হাতে কাঁঠালের জুস খেয়ে সবাই মাঠে খেলতে চলে গেলো। কিন্তু নয়নের সেদিন আর খেলতে ইচ্ছেই করলো না।তাঁরার সাথে একটু সময় কাটানোর ইচ্ছে হচ্ছিল।নয়নের উদাসীনতা দেখে তাঁরা তার কারণ জানতে চাইলে নয়ন সবকিছু খুলে বলেছিলো।তাঁরাও নয়নের সব ইচ্ছা গুলি মেনে নিয়ে নয়নকে আপন করে নিলো সহজেই।এভাবেই এই খেলা-ই ধীরে ধীরে বাস্তব রূপে আত্মপ্রকাশ করলো। সেই বন্ধু থেকে সম্পর্কটা আরও গভীরে এগিয়ে যেতে লাগলো। দুজনেই ভবিষ্যতের সাথী হিসেবে একে অপরের হাত ধরতে চাইল। অবশেষে একে অপরের হৃদয় স্পর্শ করে ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় আরম্ভ করলো।বিকেলে বন্ধুদের নিয়ে খেলার বাহানায় দু-জনের সময় কাটানোর মুহুর্তগুলো বেশ ভালোই চলছিল। একে অপরকে কথা দিয়েছিলা এভাবেই ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের সাথে বেঁচে থাকবে সারাজীবন।

কিন্তু হঠাৎ ভাগ্যের চাকা উল্টো ঘুরতে আরম্ভ করলো। তিনদিন হল তাঁরার কোনো খবর পাওয়া গেলনা। তাঁরাদের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলানো। নয়ন ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাঁর মনটা তাঁরার জন্য ছট্ফট করতে লাগলো। শেষে বাবার কাছে জানতে পারলো সরকারী কর্মচারী হওয়ার কারণে তাঁরার বাবা অন্যত্র বদলি হয়ে পরিবারকে নিয়ে সেখানেই চলে যান। নয়নের কোমল হৃদয়টা ভেঙে যাওয়ার শব্দটা যেন নয়ন স্পষ্টভাবেই শুনতে পেল। কিন্তু সে নিরুপায়। চঞ্চল নয়নকে আজ প্রথমবারের মতো নিশ্চুপ হয়ে ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখা গেল। কারণ আজ নয়ন প্রথমবার অদৃষ্টের পরিহাসকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছিল। কিছুদিন পর মাও ছেড়ে চলে গেল।জীবনের এই কয়েকটা অধ্যায়ের সম্মুখীন হয়ে সে বুঝতে পেরেছিলো জীবনের চলার পথটি এতোটাও মসৃণ নয় যেমনটা সে আগে ভাবতো। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটলো। শুধুমাত্র অপরিবর্তিত রইলো সেই মিষ্টি স্মৃতিগুলো আর তাঁরার জন্য রাখা হৃদয়ভরা ভালোবাসা। কিশোর নয়নের জীবনে যৌবনের আগমন ঘটলো।তবুও হৃদয়ে গাঁথা ছিল সেই কিশোরীর মনভোলানো উজ্জ্বল ছবি। সাবলম্বী নয়ন বেড়িয়ে পড়লো তাঁরার খোঁজে । সাধ্যমতো সব জায়গাতে খুঁজলো কিন্তু তাঁরাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলনা।

ধীরে ধীরে নির্মম ভাগ্যের সাথেই মানিয়ে নিলো নিজেকে।সংসারের প্রতি উদাসীন ভবঘুরে নয়নকেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হলো।নিজ দায়িত্বে ছোট বোন পৃথার বিয়ে দিলো। দাদা সোমও বিয়ে করে অন্য শহরে চলে গেলো। বল্টু আর অম্বরীষও যে যার মতো করে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।ছেলেবেলার সোনালী দিন গুলি জীবন থেকে একেবারেই মুছে গেলো।প্রতি দিনই বিকেল আসে ,কিন্তু নয়ন সেই হারানো বিকেলটা আজও খুঁজতে থাকে।সোনালী স্বপ্নগুলোকে আলিঙ্গন করতে চায় বার বার কিন্তু প্রতি বারই হাতছানি দিয়ে চলে যায় নাগালের বাইরে।

এভাবেই বছরের পর বছর বয়সের সিঁড়ি পেড়োতে পেড়োতে হঠাৎ সৃজার সাথে দেখা হল। নয়ন দ্বিতীয়বার কাউকে আপন করতে চাইলো। দ্বিতীয়বার নয়নের জীবনে আবার প্রেমের অধ্যায় শুরু হলো। সেই প্রেম থেকেই দুজনের বিয়ে হলো। সৃজা নয়নের বর্তমান স্ত্রী। তাদের মাহি নামে একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। সৃজা যথেষ্ট সুন্দরী, সুশীলা এবং বাড়ির সকলের প্রতি দায়িত্বশীলা। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজ হাতে খুব সুন্দর করে সামলায় আর বাড়ির প্রতিটি সদস্যের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখে। সৃজা নয়নের প্রথম প্রেমের ব্যাপারে সবকিছুই জানে এবং নয়নের সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। এখন মাহিকে নিয়েই তাদের দুজনার স্বপ্ন দেখা। ভগবান এতো কিছু কেড়ে নিয়েছেন কিন্তু তার বিনিময়ে যে সুন্দর আর দামী উপহার নয়নের জীবনে মাহি-র মাধ্যমে দিয়েছেন তাতেই নয়ন সন্তুষ্ট।মাহিকে পেয়ে নয়ন যেন অতীতের সমস্ত দুঃস্বপ্ন গুলি ভুলে গেলো। মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়েই সে অনেক খুশী।

কিন্তু মানুষ চাইলেই জীবনের সবকিছু সম্পূর্ণভাবে ভুলতে পারেনা। সেইরকম নয়নের জীবনেও ওইসব মিস্টি স্মৃতিগুলি উঁকি দেয় মণের কোণেতে।তাঁরার জন্য হৃদয়ে যে জায়গাটা ছিল সেখানে তাঁরা আজও বেঁচে আছে। বেঁচে নেই শুধু নয়নের সাথে সারাজীবনের জন্য হাত ধরে। ভগবানের ইচ্ছে ছিলো না বলে একসাথে জীবন কাটানোর পরিকল্পনাটা মিথ্যে হয়ে গেলো।আজ যখন তাঁরার ঠিকানা পেলো এতগুলো বছর পরে তখন তাঁরা ভগবানের সাথে আলিঙ্গন করে আছে।নয়নকে আশ্বস্ত করতে সে যেন বার বার বলছে, "আমি আমার কথা রেখেছি নয়ন, বলেছিলাম তোমাকে নিয়েই বেঁচে থাকবো সারাজীবন আর তোমার হৃদয়ে এখনও বেঁচে আছি আমি।" আজ নয়ন তাঁর চোখের নোনা জলকে আর বাগ মানাতে পারেনি। যে মানুষটির প্রতিটি ভালো লাগাকে নয়ন তাঁর নিজের ভালোবাসা করে গড়ে তুলছিলো, বিধাতার নির্মম পরিহাসে আজ সে আর নেই। সংসারের ঘানি টানতে গোপনে দুচোখ মুছে আবারও প্রতিদিনের মতো কাজে বেরিয়ে পড়লো সে।খবরের কাগজ টি সে খুব যত্ন সহকারে নিজের ড্রয়ারে রেখে দিল। আজকের তাজা খবরের কাগজটি হয়তো আবার অন্য কোনো দিনের অন্য কোনো ক্ষণে এক পুরোনো স্মৃতি হয়ে একরাশ তাজা ব্যথার পরশ দিয়ে যাবে।। ∆∆∆^^^^^^×××××××^^^^^^∆∆∆

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ