অনুরাগ ভৌমিক
(১)
জল পতনের একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে। ভাষা আছে।জলের শব্দ শুনে দীপক বুঝতে পারে এই মুহূর্তে মিলি অবগাহনে ব্যস্ত।অন্যমনস্ক হলো সে।সাবান হয়ে রইলো অনেক্ষণ...
সোফার উপর পর্যন্ত পৌঁছে গেল জল।সারা ঘর ভেসে যাচ্ছে জলে।একসময় সমস্ত জল দীপকের চোখে ঢোকে যায়।এখনই মিলি বেরিয়ে আসবে।চোখে চোখ পড়লে কী হবে?দীপক কী তার দিকে তাকাতে পারবে?আর মিলি?
ভাবছে নিরবে পালিয়ে যাবে।
(২)
দেখতে দেখতে তো পেরিয়ে গেছে অনেক বছর।সময় সময়ের গায়ে লীন হয়ে যায়, আর ফিরে আসেনা।যে রাতে মিলির বাড়িতে বিসমিল্লা খানের সানাই বাজলো তার পরের দিনই দীপক সব ছেড়ে চলে আসে এই শহরে।প্রায় দশ বছর। সেই থেকে টিউশনি করেই দিন চলছে।ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হেসে খেলে।বিশাল কিছু করবে এমন ইচ্ছে আর নেই।চলে যাচ্ছে একরকম।সন্ধ্যার পর স্থানীয় মন্দিরে ভাগবত বা গীতা পাঠ শুনে,হরি সংকীর্তন করে,ঠাকুরকে ডাকে। ঘরে ফিরে রান্না,তারপর খেয়ে দেয়ে একটু পড়াশোনা করে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।এই ভাবেই চলছে জীবন।মাঝে মাঝে জীবন বড় অদ্ভূত লাগে তার।
(৩
গতকালের 'আমি' আর আজকের 'আমি' পূর্ণ আলাদা যেন।দীপক নিজেকে দিয়েই ভাবে।দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে আর কামনা বাসনায় ডুববে না।ঈশ্বরের কাছে শুধু প্রার্থণা করে জ্ঞান দাও,ভক্তি দাও,সাহস দাও,বুদ্ধি দাও,মুক্তি দাও।ধীরে ধীরে বুঝতে পারে এই জাগতিক জগতে মানুষ আসে জ্ঞান ভক্তির দ্বারা নিজেকে জানার মাধ্যমে ব্রক্ষ্মকে জানতে,তাঁকে পেতে,তাঁর সাথে মিশে যেতে।ঈশ্বর অভিমুখে যাওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।তবুও মাঝে মাঝে যখন একা একা অলস সময় কাটায় মিলিকে তার খুব মনে পড়ে।মিলি পাশে থাকলে বোধহয় জীবনটা অন্য রকম হতো...
(৪)
প্রথম প্রথম ভাবতো একটা চাকরি পেলে ভালো হয়। ধীরে ধীরে সেই বাসনাও মন থেকে মরে যায়।
একটা চাকরি না থাকাতে দুজন আজ এতো দূরে।মিলিও মা বাবার অজুহাত দেখিয়ে সরে যায়।কখনো কখনো মনে পড়ে,মনে পড়ে একটা তুচ্ছ চাকরি, অদ্ভুত লাগে দীপকের।প্রেম থেকেও চাকরি অনেক বেশি প্রয়োজন?
পার্কের নিরব বসার টেবিলটার কথা ভুলে নি আজ ও।অনেক্ষণ বসে ছিলো দুজনে।মিলি বার বার বলেছে-"তুমি একটা ছোট চাকরি পেলেও বাবা রাজি হতেন।"
"আর তুমি? চাকরি নেই বলে চলে যাচ্ছ?
এতোদিনের ভালোবাসা,স্বপ্ন, সব মিথ্যে হয়ে গেলো সামান্য চাকরির কাছে?"মিলি নিরুত্তর।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দু ফোঁটা চোখের জল বিদায় অঞ্জলী দেয় মিলিকে।শেষ বারের মতো মিলি ক্ষমা চেয়ে নিলে দীপক শুধু বলে " ভালো থেকো।"
(৫)
দূর থেকে যেমন ই মনে হোক মানুষ এ জগতে একা। মানুষ এই একাকিত্ব কাটতে কাটতে এক সময় পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যায়।
মা বাবাকে ছেড়ে, জন্মগ্রাম ছেড়ে,খুব কষ্টে কাটতো দিন।তারপর সব একসময় যেমন সয়ে যায়, দীপকের ও সয়ে গেলো। তবু স্বপ্নে প্রায়ই আসে মিলি। তার শ্বাস টের পায়।কী যেন বলতে চায় মিলি বলতে পারেনা।ঘূর্ণিঝড়ের মতো কিছু এসে পরস্পর কে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।এক অজানা বনে খুঁজতে থাকে অপরকে...
ওয়ালে ঝুলানো ছবিটার দিকে আবার তাকায়।মিলিকে গোলাপি রঙের শাড়িতে ভীযন মানিয়েছে।মনে হয় এইতো সেদিনের সব অভিসপ্ত দিন।
"আংকেল তুমি আমাকে পড়াবে?"
দীপক ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আছে।একদম মিলির আদল।সে কী বলবে,'হ্যাঁ' এইটুকুই সংক্ষিপ্ত জবাব তার।এবার তো মনে হল পালিয়ে যাবে।"তোমার নাম কী"মেয়েটির উত্তর "মৌলি"
"কোন ক্লাসে পড়?"
"ক্লাস টু।
"কোন স্কুল"
"ডনবসকো স্কুল"
"বাঃ দারুন।"
"ওই যে ছবিটা,ওরা তোমার কে হন"
"ওইটা আমার মা আর ওইটা আমার বাবা।"
এমন সময় স্নান ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বছর প্রায় ত্রিশ/বত্রিশ
হবে এক মহিলা।না মিলি না। দীপকের বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। কিছু ভাববার শক্তি হারিয়ে ফেলে।এমন সময়
তিনি হাসি মুখ করে বলেন,"ও এসেছেন আপনি?
আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম ।ও আমার দুষ্টু মেয়ে ওকেই পড়ানোর কথা বলেছি।"
দীপক একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
"ওর সাথে পড়ে আদৃজা,ওই আদৃজার মা-ই কথায় কথায় বলেছে ওকে নাকি আপনি পড়ান। তার কাছ থেকেই আপনার নম্বর পেয়েছি।"
ছোট্ট মেয়েটি দৌঁড়ে কাছে গিয়ে বলে "মামণি আজ নয়,কাল থেকে পড়বো।""আচ্ছা ঠিক আছে,আগে স্যার তো রাজি হোক।"
"তাহলে স্যার আপনার টিউশন ফী বা কবে থেকে আসছেন ফোনে জানিয়ে দেবেন প্লিজ।"দীপক কোনো প্রকারে সম্মতি জানিয়ে একটা প্রকান্ড পাথর বুকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়...
0 মন্তব্যসমূহ