মানবিক ধর্মের সূচনা
পড়াশুনার শেষ নেই।৷ একজীবনে মানুষ সব শেষ করতে পারেন না। আমারও একই দশা। হাতের কাছে কিছু বই, খবরের কাগজ, টিভি, মোবাইল আর পরিবেশ প্রকৃতি পাঠ করেই শিক্ষা নিই, বিশ্লেষণ করি।
ধর্ম জিনিসটা সম্পর্কে শৈশব বা কৈশোরে একটা বোধ ছিল যে, আমরা যে পূজা আচ্চাটা করি, ব্রত উপবাস করি, মন্ত্র পড়ি, মণ্ডপ সাজাই, সেইরূপ যাঁরা পালন করেন না বা অন্যরকম ভাবে করেন, তাঁরা অন্য ধর্মের।
কিন্তু পরবর্তী কালে, পড়াশুনা ও বিজ্ঞান থেকে বুঝলাম যার মধ্যে যেটা বেশি দেখা যায় সেটাই ধর্ম। মানে জল নরম, অনুগুলি ঢিলাঢালা, এইটা জলের তরল ধর্ম। ওভাবেই ইট কঠিন, বাতাসের গ্যাসীয় ধর্ম।
আগুনের জ্বালানো ধর্ম, গাছের পরোপকার ধর্ম, পশুর খাঅন-ঘুমান ধর্ম, জীবমাত্রই বংশবিস্তার ধর্ম, জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের মধ্যে আরেকটা ধর্মের! ছাপ পড়তে দেখা যায়, যা নিম্নোক্ত ভাবনা বিশ্লেষণে স্ফুটন হতে পারে বলে মনে করি ।
বানর শিম্পাঞ্জি সহ মহেঞ্জদারো, হরপ্পা ইত্যাদি সভ্যতা দেখে আমরা এখন বিবর্তিত ঘটনাসূত্রগুলির সামঞ্জস্য মিলাতে পারছি, কিন্তু একহাজার বছর পর প্রমান ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘটনাগুলি মিলাতেই পারবেন না।
পৃথিবীতে প্রাণযুক্ত ও প্রাণহীন জিনিসের মধ্যে (বেশি লক্ষ্মণ অনুযায়ী, কাক পিঁপড়া সর্বভুক হলেও তারা পাখি, পতঙ্গ।) প্রচুর ভিন্ন ধর্ম দেখা যায়।
চোর ডাকাত হিংসুটে স্বার্থবাদী নামটা এভাবেই এসেছে বলে মনে করি । ইঁদুর বল্মীক বাদুড় ভূমিকম্পের অনিষ্টকারী ধর্ম প্রকট।
সূর্যের তাপদান, মেঘ-বৃষ্টির জলদান, গাছের ফলফুল ছায়াদান, মাটির সহ্যধৈর্য ইত্যাদি ধর্ম প্রকট।
মোল্লা, পাদ্রী, ভিক্ষু, গুরুপুরোহিতদের 'সুখে থাকার উপায়' বলাটাই ধর্ম। যদিও বিবর্তনের যুগে অধিকাংশ গুরুর মধ্যে মূলধর্মের চেয়ে নিজ সহমতে লোক টানার ধর্মটা বেশি দেখা যায়।
সুখে থাকার উপায় অনেক আগেই মানুষ খোঁজে পেয়েছিল।
সারাবিশ্বে, যখন যেখানে মানুষ প্রথম খাদ্য উৎপাদন করতে শিখেছে এবং উদ্বৃত্ত খাদ্য ভোগ করার স্পৃহা জেগেছে, তখনই সুখে থাকার উপায় খোঁজা শুরু হয় বলে ধারনা করলে, বেশি ভুল হবে না মনে হয়।
কিন্তু প্রকৃতির কাজ প্রাকৃতিক, রহস্যময়। আপাতত সবকিছুর মূলে সূর্য রয়েছেন আমরা জানি। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় তাও জানি। আগেরদিনে ভাবুক মানুষদের মধ্যেও এ চিন্তাটা জায়গা পেয়েছে বলে মনে করি। তখন তাঁরাই প্রাকৃতিক দংশন(মৃত্যু) ছাড়া, অন্য মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে উপায় খুঁজতে শুরু করেন। তখনই শুরু হয় সূচিবসন, প্রাণায়াম, স্বাস্থ্যবিধি, জড়িবুটি, । পাশাপাশি, হিংস্র জন্তু বা নরখাদককে নিয়ন্ত্রণ করা।
যিনি বা যাঁহারা প্রথম উপায় (যেমন লজ্জা নিবারণ, রিপুবধ, অসুর বধ, রাক্ষস বধ, কুংফু) বের করে সফল হলেন, তাঁদের মানুষ -- জ্ঞান তপস্বী, রাজর্ষি, প্রভু, ভগবান,পালনকর্তা এবং অক্ষাংশ অনুযায়ী 'ইস্টার' (আমেরিকান), 'মার্জানা' (রাশিয়ান), 'এনা' (ব্রিটেন') এডরাও' (আফ্রিকান), 'লুমালুমা' (অস্ট্রেলিয়ান) ইত্যাদি দেবতুল্য নাম দিতে শুরু করলেন।
বিষ্ণু মহেশ্বর, দূর্গা কালী গণেশ প্রমুখ বহুঅঙ্গ বিশিষ্ট ভগবান-- রাম, কৃষ্ণ, জগন্নাথ, হনুমান, রাবণ, মনসা, প্রমুখ ভগবান-- যীশু, বুদ্ধ, মহম্মদ, মহাবীর, আব্রাহাম(ইহুদী), বাহাওল্লাহ(বাহাই), নানক প্রমুখ ভগবান আমাদের বিশ্বাসে জাগ্রত, কেহ কেহ নিকট ইতিহাসে অনেক প্রমান ও শিষ্য রেখে গেছেন। যদিও সবক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব ইতিহাস এখনো প্রমাণ সরবরাহ করতে পারেনি, আবার সবক্ষেত্রে স্বচ্ছ আবেগে বিতর্কমুক্তও নয়। সংঘর্ষ, অসম প্রণয়, অক্ষাংশ বিশেষে ভগবানের অবমাননা, অঙ্গ বস্ত্রের অলৌকিকতা রয়েছে।
মূলকথা উপরোক্ত সবাই, যুগের পর যুগ আমাদের সুখে থাকার উপায়গুলি বলে গেছেন। কিন্তু কালের স্রোতে ভগবান বা ঋষিগুরুর মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের বলা উপায়গুলিও হারিয়ে যায়। তখন স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় শিষ্যপ্রথা এবং শ্লোক। গুরুরা বিবিধ উপায় উপাচার ওষুধ শিষ্যকে বলে যেতেন। শিষ্য তার শিষ্যকে বলে যেতেন। তারপর যখন স্মরন রাখতে অসুবিধা দেখা দিল তখন শুরু হল কষ্টসাধ্য লিপি ও শ্লোক অর্থাৎ ছন্দ আকারে বলা । আমরা জানি গদ্যের থেকে পদ্য বেশি মুখস্থ থাকে। (সাহিত্যের শুরুও সেখান থেকেই বলা যায়)। প্রস্তর লিপি, পুড়ামাটি লিপি, তাম্রলিপি, ভুজপত্র ও কাগজ আবিস্কারের আগ পর্যন্ত শুনে শুনেই শিষ্যরা ভাল থাকার উপায়গুলি ধরে রেখেছেন। শ্লোকগুলি শুধু জড়িবুটি, পরিচ্ছন্নতা, ব্যায়ামই ছিল না; নীতিমালা, অংকবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, কল্পিত দেবতুষ্টি ও দেবত্ব লাভের উপায় (অনুসরণ) মন্ত্রও ছিল। কিন্তু বহুযুগ ধরে শুনে আসা শ্লোকগুলির কিয়দংশ যে বিস্মৃত হতে পারে বা সংযোজিত হতে পারে, তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। স্রুতিস্তর ও ব্যায়সাপেক্ষলিপি পেরিয়ে, শেষে কাগজে সুরক্ষিত হওয়া 'উপায় গুলিকে' আমরা শ্রুতি কাব্য বা বেদ বা ধর্মগ্রন্থ বলি। গীতা বাইবেল কুরান ত্রিপিটক জেন্দাবেস্তা পড়লে দেখা যাবে, গ্রন্থগুলিতে ঐ ভাল থাকার উপায়গুলিই লিপিবদ্ধ আছে । আমরা সবাই প্রতিযোগি ভাব ছেড়ে সবটা অনুসরণ করলে পৃথিবীতে কোন সংঘাত থাকবে না।
দীর্ঘ ও বহুযুগ ধরে, মানুষ মানুষকে এভাবেই রক্ষা করে এসেছেন বলে একে মানুষের ধর্ম বলা হয় অর্থাৎ মানবিক ধর্ম ।
দুর্ভিক্ষ বা দুর্ভিক্ষের আবহ মানবিক ধর্মের সবচেয়ে বড় শত্রু। সে সময় ক্ষিধের জ্বালায় মানুষ মানুষের রক্ত খেতেও পিছপা হয় না।
মহাপ্রভু নিমাই, লোকনাথ, সিড়ডি সাঁই, লালন ফকির, রামমোহন, ঈশ্বর চন্দ্র, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, রামঠাকুর, অনূকূল, রবীন্দ্র, নজরুল, কামারুযযামান, টেরেসা, বিবেকানন্দ, প্রমুখ অতি সাম্প্রতিক ইতিহাস। মানবিক ধর্ম রক্ষায় তাঁরা আজীবন কাজ করে গেছেন। মানবিক ধর্মই সবদেশের অগ্রগতি ও প্রজন্মের বাসযোগ্য পৃথিবীর একমাত্র চাবিকাঠি। (সংক্ষেপিত)
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
,,,,,,,,বিভিন্ন সাময়িকী পরিবারগুলো যখন সংস্কৃতি ও মানবিকতার প্রসারে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নিরলস কাজ করে চলেছে ঠিক তখনি দূরে কোথাও ঘটে যাওয়া পরিপন্থী অনভিপ্রেত ঘটনাগুলি আমাদের ভাবিয়ে তুলে। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে মনুষ্যত্বের উপলব্ধি ও প্রয়োগের আরও বেশি প্রচারের গুরুত্ব আছে বলে মনে করি। ধর্মের বিভাজন নয়, আমরা ধর্মের সূচনায় ফিরে যেতে চাই ।
0 মন্তব্যসমূহ