✍️ দিব্যেন্দু নাথ
উত্তর ত্রিপুরার জেলাশহর ধর্মনগর বা পেচারথল স্টেশনে নেমে, ম্যাক্স (প্যাসেঞ্জার) বা ছোট গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে আসা যায় দেওনদীর পারে অবস্থিত; নীল পাহাড়ের প্রান্তিক শহর কাঞ্চনপুর। এখান থেকে পূর্ব মুখিয়ে দাঁড়ালে চোখ ঝলসে যায়। প্রেম
বিষে নীল হয়ে ওঠা যুবতির শরীরের মতো হৃদয় কাতরে ভরা শায়িত, আর কেউ নয়! আমার-ই জম্পুই। কাঞ্চনের বুক থেকে কুড়ি কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি চড়াই উঠলেই তার জানুদেশ, মুনপই। উত্তরে নিতম্ব বেয়ে নেমে গেছে তার আলতা পরা পা, তুঙছুরাই পর্যন্ত। সেখানে থেকে চাইলে সদাইহাম পাড়া ঘেঁষে পূনরায় কাঞ্চনপুর আসা যায়।
জানুদেশ থেকে দক্ষিণে নাভি পেরোলে ডায়েবায়ে সুগভীর খাল। ক্লান্ত হৃৎপিণ্ডের মতো উঠানামা করা সড়ক পথ চলে গেছে ক্লাঙতালাঙ পর্যন্ত। তারপর কাঁটা তার। নীল কন্যার এক পাশ বিঁধে রাখলেও মন তার খোলা আকাশে নীলময়।
অনন্যার দুর্বিনীত স্তনযুগলের একটি ভাঙমুনের চার্চে রেখে দিলেও আরেকটি ফুলদুংসাইএর সুগভীর জঙ্গলে, শিবরাইখুং পাথর খণ্ডে। যার বংলা অর্থ শিব মন্দির। মাত্র আশি বছর আগের এই শিবরাইখুং। মিজোরামের খ্রিস্টান রাজা খাতিন চাওম্যুএর রাজত্ব কালেও মিজোরা এই স্থানটিকে 'থাইদর' নামে জানত। মিজো ভাষায় 'থাই' শব্দের অর্থ, সন্তানহীন বিবাহিত মহিলা আর দর - পূজা। অর্থাৎ সন্তান প্রাপ্তির আশায় তারা এখানে পূজা দিত।
১৯৪৩ সালের রিয়াং বিদ্রোহের অধিনায়ক সাধু রতনমণি এখানে একটি পাথর খণ্ড দ্বারা এই শিবরাইখুং স্থাপন করে ছিলেন। কিন্তু কে বা কারা এক ঐতিহাসিক রাতের অন্ধকারে, সাধুর পাথর খণ্ড সরিয়ে ক্রশ বসিয়ে দেয়। এটা বিতর্কিত বিষয়; তা নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। হয়েছে তো ঈশ্বরের কোনও পয়গম্বরের স্থান।
পরবর্তীকালে সরকারি সার্ভে অনুসারে এই স্থানটি ত্রিপুরার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ পরিচিতি লাভ করে এবং নাম হয় বেতলিংশিব। আজও ফুলদংশাই পাহাড়ের কোলে ঘন জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ একাকী। তবে আজকেরণ অদৃশ্য ঘণ্টাপাখির ডাকে উন্মত্ত নীল-দুহিতার মুখরিত অঙ্গ আরেক সুরেলা বিহঙ্গের গানে আমোদিত হতো একসময়। ঘণ্টা পাখির কথা সব পর্যটক জানলেও এই পরোপকারী বিহঙ্গের কথা অনেকেই জানেন না। কারণ তারা আর বেঁচে নেই। ঘণ্টাপাখির গানের মতো তাদের গান আর শোনা যায় না। ঘণ্টাপাখির বিদুরিত আওয়াজ, প্রথমে কৌতুকপ্রদ মনে হলেও দীর্ঘক্ষণ বিচরণের পর মনে হয় খুব বিরক্তকর। কিন্তু সেই সুরেলা বিহঙ্গের গান ছিল মধুময়। তারা শুধু গান করত না! এক পরাগ সংযোগকারী পতঙ্গের জন্য সুস্বাদু খাবার প্রদান করত। তা মুলত তাদের বিষ্ঠা। এই বিষ্ঠা খেয়ে পরোপকারি পতঙ্গরা বেঁচে থাকত। সর্বক্ষণ তারা নীল দুহিতার কমলা রঙা উরুতে ব্যস্ত থাকত পরাগ সংযোগে। আধুনিক বহরতায় ডুবে থাকা এক শ্রেণির সর্বভূক তাদের পৈচাশিক খাবারের চরিত্রার্থ করতে গুলিবিদ্ধ করে ধ্বংশ করেছে এই বিহঙ্গকে।
মুক্ত বিহঙ্গকে শূন্য করে নগ্ন করেছে নীল দুহিতার শরীর। যারজন্য লজ্জায় সে, আর কমলা ঠোঁটে হাসে না। শুধু বাঁচার তাগিদে সবাইকে আপ্লুত দেখাতে, সাঁতকরা আর সুপোরির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে এখন। মাতাল হয়ে বিচরণ করে কংকীটের কংকালসার বাসরে। প্রায় ভুলতে বসেছে, বাঁশবেতের গাইরিংয়ে( টংঘর) বাধা কাঠের সানসিতে (সিঁড়ি) পা রাখতে। যেন উন্মাদ যুবতী। একদিন যার সুবাসিত কমলা গন্ধে মনে উঠত - বিনোদ আর আহ্লাদ। যার আওলা কেশের সুগন্ধ ছড়িয়ে যেত নীলদিগন্তে। আজ আর সেই সুবাস নেই। নেই সেই বিহঙ্গের সুরেলা গান। তবে আছে জানুদেশে, সুরেলা ঝর্ণার শীতল ঢেউয়ের হাতছানি আর সারা গায়ে সবুজ ভরা কিছু মৌতাতের ডাক।
বিধাতার বড় প্রিয় এই নীলাম্বরী এখনও। ত্রিপুরার অন্যান্য পাহাড়গুলিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা দিলেও জম্পুইকে করেছেন রাজরাণী। বিহঙ্গহীন প্রিয়তমা করেও তার মতো কাউকে এতটা শিক্ষা-দীক্ষায়, ধনসম্পদে সমৃদ্ধ করেননি তিনি। কেন তাঁর এই নিষ্ঠুরতা, এই দ্বিচারিতা। আজও সকল পর্যটকের মনে প্রশ্নের বহর তুলে।
ফুলদুংশাই থেকে আরও কিলোমিটার দশেক এগোলে ইন্দ-বাংলা বর্ডার। এখানে থেকেই আবার মিজোরাম রাজ্যের লুংলে জেলা শুরু। পাহাড়ের গগনচুম্বী গাছগুলি আকাশের নীল ছুঁতে ছুঁতে পশ্চিমে ঢলে পড়ে। বাতাস বয়ে নিয়ে যায় শাখানের কাছে। ঘন কালো বিনুনীর কমলা সুবাসে মাতাল হয় সে। যুবতীর ঘামেলু কামুক গন্ধে শিউরে ওঠে তার তন্ময় দেহ।
মৌতাত-ভরা নারীর প্রেম, যুবক কেন কোনও পুরুষ-ই ফিরিয়ে দিতে পারে না। শাখান তো এক সটান চির যুবক! কিছুতেই নীরব থাকতে পারল না। আপ্লুত হয়ে সুমু বাজাতে লাগল মনকাড়া সুরে। একদিন অনুনয় হাতছানি দিয়ে প্রেমের বহরতা মাপতে ধীরে ধীরে নামতে লাগল পাদদেশে।
মায়াময় ইশারায় জম্পুই টগবগে। সাড়া না দিয়ে পারে? সে-ও প্রেমসিঞ্চনে নামতে লাগল পুরুষ শাসিত সমাজের সব অপবাদ ভুলে। আদৌ কি সেকথা ভুলে গেছিল সে? নাকি উন্মাদিনী হয়ে ছিল? নিজকে ভাসিয়ে দিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক তারা ছাড়া জ্যোৎস্না ভরা সন্ধ্যায়। তার কমলা রঙা পায়ে কি সেদিন নূপূরছন্দা ছিল! কে জানত।
মেয়েদের গোপনে রাখা অন্তর বিকশিত প্রেম সিঞ্চন, অজান্তেই বনানী কল্লোলিত করে দিল। পুরুষ শাসিত সমাজে, কোনো মেয়ে কি আর জানলে? তার অহংকার বিলিয়ে দেয়! অচেনা সুমুর সুরের টানে ছুটে যায়? - যায়, প্রেমের মাধুর্য তো এখানেই। অজান্তেই নিজের সবকিছু হারিয়ে যায়। পাখিরা মিলনের গানে ভরে দিল সবুজ গাছগাছালির ডাল। আলিঙ্গন অভিলাশে তারা অনুসন্ধান করতে করতে দুজন একদিন একত্রিত হল। একে অপরকে ভালো করে দেখার আগেই এক দৈত্য গিলে ফেলল দুজনকে। কোন শাপ থেকে নাকি মুক্তি পেতে! সে কুমারী জম্পুই আর কুমার শাখান দেখে বসেছিল এই পবিত্র উপত্যকায়। তাদের ছোঁয়া পেয়ে শাপমুক্ত হবে। আজ হল তার প্রায়শ্চিত। কাঙ্ক্ষিত প্রেম সিঞ্চনে সুন্দর হতে লাগল তার বিদঘুটে দেহ। প্রেমের অনুরণে বিকশিত হল স্বার্থপর হৃদয়। স্নিগ্ধ উপত্যকা, বিশুদ্ধ বাতাস আর আলো জল পেয়ে তৈরী করল আদর্শ জলবায়ু। তকতকে পলিতে ভরে উঠতে লাগল পাড়। ধীরে ধীরে সবুজে আচ্ছাদিত হল নতুন মাটি। জন্মনিল অগণিত ইতর প্রাণী। কত মাস কাল যুগ পেরিয়ে কত জল গড়াল তার বুক দিয়ে, - কে জানে!
শুরুহল মানুষের আনাগোনা। উপত্যকা দিয়ে প্রথম নাকি হালামদের যাতায়াত ছিল। পাহাড়দ্বয়ের নির্যাসিত প্রেম-সিঞ্চনকে তারা দেওপানী নামে ডাকত। এমনকি প্রায়ই মোহনায় এসে দেখে যেত 'দেও' এখন এক নারীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কী অপূর্ব সুন্দরী সে। নাম তার মনু। পিতামহ ভীষ্মর ন্যায় সেখাকার পাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক বপুর শিমুল। প্রাগৈতিহাসিক যুগে তার তলা নাকি কুলষিত হয়েছিল, সিলেটের গারো পাহাড় থেকে আগত একদল দৈস্যু দ্বারা। তারা পটিয়ান পূজার নামে মানুষ বলি দিত। ইতিহাস যাদেরকে নি-র্মুন্ড জাতি হিসাবে আখ্যায়িত করেছে আজ।
জম্পুই শাখানের অমর প্রেমগাঁথা মিলনস্থল অশুদ্ধ হয়েছে ভেবে তদানীং মহারাজ ধরম-ফা, শ্রীহট্টীয় পাঁচ বেদজ্ঞ পণ্ডিত এনে যজ্ঞ করেছিলেন মোহনার খানিকটা উজানে জয়পর্ব্বতের পাদদেশে। কেউ কেউ মনে করেন মহারাজের এই প্রাগৈতিহাসিক যজ্ঞ নাকি ত্রিপুরার রাজবংশের প্রথম হিন্দু ধর্ম গ্রহণের সোপান। কিন্তু 'রাজমালা'-য় বর্ণিত আছে ত্রিপুরার মহারাজগণ চন্দ্রবংশী। এই বিতর্কিত বিষয়ে যাচ্ছি না; ফিরছি মুল বিষয়ে।
রমণীর মৌতাতে বিলিয়ে যাওয়া 'দেও' প্রথমে - 'দেওপানী'। অনেকযুগ পরে চাকামাদের কাছে 'দেরগাঙ' হল। সর্বশেষ বিবর্তন বাংলার আগ্রাসন - 'দেওনদ' বা 'দেওনদী'।
যাইহোক, নামে আর কি যায় আসে! 'দেও' তো দেও-ই রইল। জম্পুই-শাখানের অমর প্রেমভরা সিঞ্চনে কল্লোলিত হচ্ছে আজও। মোহনায় কান পাতলে এখনও শোনা যায় পাঁচ বেদজ্ঞ পণ্ডিতের সুরেলা মন্ত্র উচ্চারণে চাপিয়ে যাওয়া নরবলি প্রথা।
কবি পরিচিতি : দিব্যেন্দু নাথ।
পিতা: শ্রীযুক্ত ইন্দুভূষণ নাথ।
মাতাদেবী: শ্রীমতি বীনাপাণি নাথ।
গ্রাম - শান্তিপুর,
পো: কাঞ্চনপুর,
জেলা: ত্রিপুরা (উঃ) কবিতা উপত্যকা; ভারত।
চলভাষ : ৯৮৬২৬০৩৬৪০
জন্ম : ৫ ই মে ১৯৭৭ ইং
পেশা : পরামর্শদাতা (ভারতীয় জীবন বীমা নিগম)
নেশা : সাহিত্য চর্চা।
সম্পাদিত ম্যাগাজিন: 'দোপাতা' সাহিত্য পত্রিকা।
প্রকাশিত উপন্যাস: - 'আইলাইনার'।
প্রকাশিত গল্প: - জমিন আসমান।
0 মন্তব্যসমূহ