✍️ অনুকূল দেবনাথ
লক ডাউন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কেন জানেন? এই যে ধরুন স্কুলের সামনে, হাটে কিংবা বাজারে, অফিসে, রাস্তার দোকানের সামনে, বাসস্ট্যান্ডে, প্রতিনিয়ত আমি যখন প্রভৃতি স্থানে যাইতাম, তখন ঐ স্থানগুলিতে কিছু নিরীহ প্রাণী এবং ভবঘুরে দেখতে পাইতাম। আজ বিশ্বব্যাপী মহামারীতে বিশ্বের দাবড় দাবড় রাষ্ট্রের সাথে ভুগছে আমার ধ্যানের ভারতবর্ষও। দেশে চলছে লক ডাউন। লক ডাউনের আগের ভারতকে দেখতাম আমি এক ব্যস্ততম পর্যায়ে। সময়ের মূল্য ছিল অগণিত। প্রতিটা গলি ছিল চা আর কাজের ব্যস্ততায় এবং আড্ডায় ভরপুর। আজকের ভারত যেন অন্যকথা বলছে। দোকানির অনেকদিন হল ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে না দোকান। সামান্যমাত্র কয়েকটি মুদিখানা খুলছে তাও সময়ের সাপেক্ষে। মানুষ সেখান থেকে গন্ডির লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছে। সবজি বিক্রেতা খুব সুন্দর করে দোকান সাজিয়ে বসে থাকলেও মিলছেনা চাহিদা অধিক ক্রেতা। ফল বিক্রেতা দাড়িয়ে রয়েছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। ভরসা পাচ্ছেনা কেউ কোনোকিছুতেই। কী ছিল আর কী হয়ে গেল এই সোনার ভারতবর্ষ?
আমি ভাবিয়া পাইনা কেন আজ মোরা এই নিদারুন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি? ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে করোনা মৃত্যু সাইক্লোন আর করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা। একেকটা দিন কাটছে ভয় আর বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে। মানুষ আজ হয়েছে গৃহবন্দী। প্রকৃতির জীবজন্তুরা পেয়েছে আজ অবাধ স্বাধীনতা।
কিন্তু ভারতবর্ষকে আজ আমি দুটো পিঠে দেখতে পাচ্ছি। ভারতের এক পিঠে চলছে লক ডাউন মান্য করা আর মরণব্যাধি সারানোর লড়াই। অপর পিট যদি দেখি করুণায় আশ্রিত অশ্রুজল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা এই স্বজনদের চোখে।যাঁরা মানুষের ফেলা জিনিসটুকু খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে বা রাস্তার ধারের ফুটপাতে কিংবা ডাস্টবিন থেকে খেয়ে জীবনধারণ করতো আজ তারা সেটাও পাচ্ছেনা কিছুতেই। কেননা আজ অভুক্তদের জন্য ফেলছে না কেউ সেই বাড়তি খাবার। নিত্যদিনের মতো বাসে উঠার জন্য আসছেনা যাত্রীরা। অফিস বাবুরা যাচ্ছে না কর্মস্থলে। তাহলে কেমন করে মিলবে সেই অভুক্তদের পেটে খাবার? আজ সেই কুকুরটা শুধু এদিক-ওদিক ঘুরছে কিন্তু দোকানিকে কিংবা গাড়ির জন্য অপেক্ষারত লোকটিকে দেখতে পাচ্ছেনা। দেখলে হয়তো একটা বিস্কুট অথবা একটু খাবার জুটতো তার ভাগ্যে। কোথাও সে লোক সমাগমের ভীড় দেখতে পাচ্ছেনা। রাস্তা পারাপারের জন্য আজ তাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। একমাত্র আজ সে সম্মুখীন হল একমুঠো খাদ্যের জন্য। দিনের পর দিন সে খাবারের জন্য কাতরাচ্ছে। মানুষ-তো নিদিষ্ট পরিমাণ খাবার সংগ্রহ করে জীবনধারণ করছে। কিন্তু এই অভুক্তরা কী পারছে তা করতে? রাস্তার ধারের ভবঘুরেরা আজ বুঝতে পারছে না কিছু। তাঁরাও আজ অনেকটা নরকঙ্কালের বেশ ধারণ করেছে। কেউ আজ তাঁদের একটা অর্ধেক রুটিখানা কিংবা সামান্য একটু জলখাবার তুলে দিচ্ছে না। রাস্তার পাগলটাও আজ এই নিদারুণ পরিস্থিতির স্বীকার হল। সেও খুদায় পেটের জ্বালায় কাতর হয়েছে। পাগলামি ছেড়ে আজ সেও দিশেহারা হয়ে চুপটি করে বন্ধ দোকানের বারান্দার উপর বসে বসে কী যেন ভাবছে... একমনে। কিন্তু এই অভুক্তরা হল আজ স্বাধীন। কেউ তাঁদের আজ মানা করছে না কোনো কিছুতে।
একেকটা পরিস্থিতি যেন কিছু শেখাতে আসে। স্বাধীন মানুষ আজ গৃহবন্দী হল আর পরাধীনরা আজ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নীচে স্বাধীন মনে আছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে আছে কোনদিন একটা নতুন সূর্য দেখতে পাবে? প্রত্যেকটা দিন যেন কাটে একটা নিদারুণ মৃত্য যাত্রীর সঙ্গী হয়ে। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক মানুষ চলতে বাধ্য হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অমান্য করতেও বাধ্য করা হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষকে। গ্যালিলিও সেইদিন বলেছিল পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু বিশ্বের ধর্মীয় ব্যবস্থা সেদিন এটা স্বীকার করেনি কিছুতেই। গ্যালিলিওকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় কায়েম ব্যবস্থার কাছে। যার কারণে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীকে। কিন্তু শেষে এই গ্যালিলিওর কথাই ফলপ্রসূ হল। মানতে হল সবাইকে একদিন গ্যালিলিও-ই ছিল সঠিক। আজ যখন চিনদেশ এই কারোনা ভাইরাস এর উৎপত্তি ঘটাল তখন তা বিশ্বের মধ্যে মানুষ মারার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটা দিন মরছে হাজার হাজার মানুষ। বিশ্বের দাবড় দাবড় রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে। চিনের এই অমানুষিক ভাইরাস উৎপত্তির কারণে সারা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ এগিয়ে চলছে। ভুক্ত থেকে অভুক্ত মরছে সবাই। আর এর উল্টো দিকে ধর্মীয় কায়েমে অন্তর্ভুক্ত কিছু ব্যক্তি এখনো করোনার মতো ভাইরাসের কাছে তাঁরা মাথা নোয়াতে নারাজ। প্রতিদিনকার মতো তাঁরা এখনো ধর্মীয় সুরে ধমকি দিচ্ছে করোনাকে। আজ এজন্যই গ্যালিলিও-র গল্পটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আমার কাছে। ধর্ম মানুষকে শান্ত করে আর শিষ্টাচার শেখায়। অন্যদিকে বিজ্ঞান মানুষকে জ্ঞান তথ্যের বিশ্লেষণে উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে বাঁচার পথ দেখায়। কিন্তু আজ ধর্ম আর বিজ্ঞান একে অপরের বিপরীত হয়ে গেল ধর্মের নামে বিভ্রান্তিকর ব্যক্তিদের কাছে। ২২ এপ্রিল ২০২০ এর দুপুরবেলায় মনের একাকিত্বে ভাবনা।