কালো না ফর্সা

✍️ অমৃকা মজুমদার

      চারিদিক থমথমে একটা পরিবেশ।বদ্ধ একটা রুম।পরিচিত আপনজনের কোন মুখ দেখা যাচ্ছে না।অচেনা কিছু মুখ।শরীর অসাড়,নিস্তেজ ।শুধু চোখ দুটি সজাগ ।অপলক  দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই মুখগুলির দিকে কোন একটা বহু প্রতীক্ষিত সুসংবাদ শোনার অধীর আগ্রহে।শায়িত অপারেশান থিয়েটারে
কৃষ্ণকলি দেখতে পাচ্ছিল দুজন ডাক্তার ,তিন জন নার্স অস্ত্রসস্ত্র শুধু নাড়ানাড়ি করছিল।সে অনুভব করছিল ওর পেটের ঝাঁকুনি  আর ওদের ফিসফিস শব্দ।  --কিছুক্ষন বাদেই ডাক্তারবাবু ফুটফুটে একটা শিশুকে দুহাতে গলায় ধরে ঝুলিয়ে ওকে বলছিল,"দেখ মা,তোর ঘরে লক্ষ্মী এসেছে, একদম তোর মত দেখতে হয়েছে।"
---কিছুটা আনন্দের ,কিছুটা উদ্বিগ্নের মধ্যে নির্বাক কৃষ্ণকলি তখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল শুধু এটা জানার জন্য যে  সদ্যজাত শিশুটি কালো না ফর্সা হল ,ওর মতো কালো হয় নি তো? কিন্তু কথা বলতে পারছিল না কারণ এনেস্থেসিয়ার কারণে মুখে জোর পাচ্ছিল না।
--সিজারিয়ান ডেলিভারি ।প্রথম সন্তান।সেই প্রথম এক নজর দেখেই কখন ঘুমিয়ে গেলো সে বুঝতে পারে নি।জ্ঞান ফিরতেই দেখে ওর আশেপাশে অনেক প্রসূতি মায়েরা। 
--ওদের একজন বলছিল ,"বেশ দেখতে তোমার বাচ্চাটা"।
---কিন্তু মনে চলছিল নানা জল্পনা কল্পনা।যাই হউক,ওরা ফর্সা বলায় মোটামুটি আশ্বস্ত হল আর একটু স্বস্তি পেল যে,না,অন্তত ওর মত হয় নি,বাচাঁ গেলো।
--ছয় দিন পর ছুটি পেয়ে যখন বাড়িতে প্রবেশ করল,
পাড়া -পড়শীদের মুখে শুধু একটাই বুলি," না,মা-র মতো হয়নি।চিন্তা নেই।"
---অনুভব করছিল সে তখন যে  শ্বশুরবাড়ির মানুষেরাও একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।বেজায় খুশি সবাই।
--ছেলেকে বিয়ে করানোর সময় যতসব দুশ্চিন্তা ছিল ওসবের একটু প্রশমন হয়েছে। বাচ্চা টা অন্তত কালো হয় নি।
কালো মেয়েকে বিয়ে করলে পরবর্তী প্রজন্ম কালো হয়েই জন্মাবে ----এই ভয়টা খানিকটা কেটে গেল।
--আবার কেউ কেউ বলছিল,"এখন ফর্সা দেখালেও কিছু দিন পর রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাবে।মায়ের রং নি পায় পরে কে জানে!" 
--নানান মানুষের নানান কথা।

      ----যখনই বুঝতে শিখলো সেই থেকে কৃষ্ণকলি একটা কথা শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে।
---ওর মা বাবাকে প্রায়ই শুনতে হত," মেয়েটাকে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে,ভালো করে পড়াশোনা করান।আবার বেশি পড়ালেও ক্ষতি কারণ উপযুক্ত পাত্রস্থ করতে হলে গাঁটের পয়সা ফুরিয়ে যাবে।" ---বিয়ের সম্বন্ধ আসলেই পাত্র পক্ষ বলতো," মেয়ে কালো অনেক পণ লাগবে।"
---- ওর মনে হত টাকা দিলে ,পণ দিলেই কালো র কলঙ্ক ঢেকে যাবে!
-- এমতাবস্থায়  কৃষ্ণকলি ঠিক করে এখন আর বিয়ে করবে না।বয়স যখন হয়েই গেছে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী  হয়ে বিয়ে করবে।--
----মন দৃঢ় করে কঠোর পরিশ্রম করে সে একটা ভাল সরকারি চাকুরিতে জয়েন করে এবং ভালোবেসে বিয়ে করে নেয়।
---কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা নেই। 
--শ্বশুরালয়ে গিয়েই শুনতে হয়েছে ওদের পরিবারে কেউ কালো নেই।এই বুঝি কালো যুগের  সূচনা হল।
---তারপর সন্তান সম্ভবা হলেই সকলে বলাবলি করত বাচ্চাটা যেন মায়ের মতো রং না পায়।
---তাই যেদিন অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারবাবু ওর ফুটফুটে শিশুটাকে এক নজর দেখাল,ওই মুহূর্ত টা ওর জীবনে লাল অক্ষরে অবিস্মরনীয় হয়ে রইল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ