✍️ সুজিত ভৌমিক
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- 'ত্রিপুরাকে কেন ভালো লাগে '? ত্রিপুরার মূল আকর্ষণ কি বা মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই কি?' ত্রিপুরার প্রকৃত ও মূল বৈশিষ্ট্যই বা কোথায় অথবা ত্রিপুরা কিসে শ্রেষ্ঠ? ' উত্তরদাতা যদি বিদেশি তথ্য ফরেনার হয় তবে হয়তো বলবেন, ''Tripura is best in It's forest'। অথবা বলে বসবেন, 'The forest of this state is dense and unique ''। কোন বহিঃরাজ্যবাসী ভারতবাসী হয়তো বলবেন 'ত্রিপুরার অরণ্যের তুলনা নেই।' আর এ রাজ্যের কাউকে তথা ত্রিপুরাবাসী কোন একজনকে প্রশ্ন করলে- 'ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ সম্পদ কি? অমনিই, তৎক্ষনাৎ চোখবুঁজে একটি ও একমাত্র উত্তরই আসবে। আর সে জবাবটি বা উত্তরটি হল, ' অরণ্য সম্পদ।' আবেগ তাড়িত হয়ে কেউ হয়তো বলবেন, 'ত্রিপুরার একমাত্র সম্পদ অরণ্য সম্পদ।' ত্রিপুরার একমাত্র ঐশ্বর্য অরণ্য ঐশ্বর্য।
আর বলা বাহুল্য, অরণ্য অভ্যন্তরে বা বনের স্পর্শে যাদের বাস, বিশেষ করে যে সমস্ত উপজাতি অংশের মানুষজন অরণ্যবাসী, তাঁরা যদিও আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে অরণ্য, গাছপালা, বৃক্ষ ইত্যাদির উপর নির্ভর করেন, অরণ্য উদ্ভিদের ফল, মূল, পাতা, শুকনো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, গৃহের পরিকাঠামো ও আচ্ছাদনের জন্য, পশুপালনের জন্য, বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ ও রোগপীড়াতে ভেষজ উদ্ভিদাদির ছাল, পাতা, ডাল ও পুষ্প, ফল ও মূলের নির্যাস সংগ্রহ ইত্যাদির জন্য অরণ্য অভ্যন্তরের গাছপালা ও বৃক্ষাদির উপর নির্ভরশীল, তবে একথা অনস্বীকার্য যে তাঁরা বন, অরণ্য, বৃক্ষ ও উদ্ভিদকে গভীর ভাবে ভালবাসেন, বনের বৃক্ষাদির প্রতি প্রীতি, বনবাসীদের সবুজ গাছপালার প্রতি গভীর অন্তরের টান, প্রাণের আকর্ষণ ও হৃদয়ের উষ্ণ ভালবাসা। নয়তো তাঁরা কিন্তু সংখ্যক হলেও অরণ্যভূমি ছেড়ে বনের ঠিকানা ত্যাগ করে মলস্রোতে সামিল হতেন, কিছু বা স্বল্প সংখ্যায় হলেও লোকালয়বাসী বা গ্রামবাসী হতেন, বা শহরের চাকচিক্য বা সুযোগ সুবিধা, আরাম আয়েশ ও বিলাসিতার অংশীদার হতেন। সুতরাং যারা বনবাসী, অরণ্য অভ্যন্তরের যাদের বাসস্থান, তাঁরা অরণ্য ও বৃক্ষাদিকে অতি কাছের বস্তু, অতি বিশ্বস্ত ও আপনজন, অন্তরের ভালোবাসার ঐশ্বর্য্যে লালন করা স্বর্গসুখ বস্তু, দুর্লভ সুখের ধন হল এই বন ও অরণ্য। একথাই আসল সত্য যে, অরণ্য ও বনবাসীরাই অরণ্যকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। যাইহোক, ত্রিপুরার অরণ্যের হাতছানি অন্তহীন, সীমাহীন ও দুর্বার। ত্রিপুরার অরণ্যের গভীরতা, সতেজতা, দুর্ভেদ্যতা, সবুজের অবিচ্ছিন্নতা, বিচিত্র সব পাখিদের কলকাকলি ভরা ছন্দের উদ্দামতা, সীমাহীন সবুজের মোহময়তা, বিচিত্র সব গাছগাছালির রহস্য ও রোমাঞ্চ যেন এক অন্যবিল আনন্দ, এক স্বর্গীয় অনুভূতি, একবুক বাতাস, উদাসীন সনের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া আর ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া মন জঙ্গলের ঘোর আবর্তে, গহন বনের নিঃঝুম, নিঃশব্দ শীতলতায় এ যেন নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, মন হারানো বনের সবুজে মুক্তির স্বাদ, অনন্ত শান্তির বার্তা, স্বর্গীয় সুষমার হাতছানি। আর ত্রিপুরা অরণ্যেই এই বৈচিত্র্য ও বিভূতির প্রকাশ৷ ত্রিপুরার অরণ্য তাই অনন্য।
উল্লেখ্য রাজন্য আমলে এরাজ্যে 'হাতি খেদা' নামে একটি শব্দবন্ধ তথা মজাদার ও ঐতিহাসিক শব্দযুগলের কথা জানা যায়। এ রাজ্য থেকে তখন বহিঃরাজ্যে হাতি বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের অর্থ আয়ের উৎস স্বরূপই এই 'হাতি খেদা' অভিযানের সূচনা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই রাজ্যে তখন হাতির সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০টির মতো। দক্ষিণের গোমতী, অমরপুর, বামপুর, উত্তরের মনু, আমবাসা ও তেলিয়ামুড়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে হাতিদের আনাগোনা ছিল সর্বাধিক ও লক্ষণীয় ভাবে উল্লেখযোগ্য। এ রাজ্যে প্রায় ১৫৪৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে । অরণ্যাঞ্চলের পরিধির বিস্তৃতিও ছিল খুবই সন্তোষজনক ও সর্বোচ্চ মাত্রা বিশিষ্ট। বলা যায় গভীর, গহন, ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল ভারতের বৃহৎ অংশের ভূমি অঞ্চল। যেমন খ্রীস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বর্ষ নাগাদ ভারতের মোট ভৌগোলিক আয়তনের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ অঞ্চল ছিল অরণ্যাবৃত। আর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ৪০ শতাংশ বনাঞ্চল। ১৯৫১ সালে তা নেমে যায় ২২ শতাংশে,
আর ১৯৯৫ সালে বনাঞ্চলের পরিমাণ দাঁড়ায় কমবেশি প্রায় ১৯৩৯ শতাংশে।
উল্লেখ্য, ত্রিপুরা রাজ্যে ২০০৩ বন সমীক্ষা অনুযায়ী বনাঞ্চলের আয়তন ৬২৯৪.২৯৩ বর্গকিমি এবং বৃক্ষ রয়েছে এখন এলাকার পরিমাণ ৮০৯৩ বর্গকিমি। প্রায় ৩০৪৭ বর্গকিমি জুড়ে রয়েছে উন্মুক্ত বন। উল্লেখ্য, ভারতের উদ্ভিদ সাম্রাজ্যের ১২.৮৬ ভাগ উদ্ভিদ এর আবাসভূমি হল এই ত্রিপুরা। যদিও মাথাপিছু বনের পরিমাণ তথ্য বনভূমির আয়তন (per capita area of forest land)- এর ক্ষেত্রে পৃথিবীতে সবচেয়ে নিম্নে হল ভারত। আর বর্তমানে পৃথিবীতে বনভূমি হ্রাসের বার্ষিক হার ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর। উল্লেখ্য, উদয়পুরস্থিত জগদ্বিখ্যাত, সতীর একান্ন পীঠের একটি, মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন বৃহৎ দীঘি কল্যাণ সাগরে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ বর্তমান। এই বিরল প্রজাতির কচ্ছপগুলি বৃহদায়তন ও বয়সে অতিপ্রাচীন এবং পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পরিশেষে বলি ত্রিপুরার অরণ্যে রয়েছে সাক্ষাৎ বনদেবী (Living Goddess of forest) এর অবস্থান ও অধিষ্ঠান। ইংরেজ দার্শনিক ও মনীষী তথা বিখ্যাত লেখক Francis Bacon (1561-1626, English Politician, Philosopher, and essayist) এর গুরুগম্ভীর ও প্রগাঢ় তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি দিয়েই এ নিবন্ধের ইতি টানছি। Francis Bacon বলেছেন,
" God Almighty first planted a garden ; and indeed, it is the purest of human pleasure. "
0 মন্তব্যসমূহ