✍️ দিব্যেন্দু নাথ
- আমি যদি আবার নাইনের ছাত্র হই, তুমি কি সেভেনের ছাত্রী হবে?
- না।
- কেন?
- দাদাদের মাঝে! দাদা দাদা বলে আবার তোমাকে খোঁজাবো?
- এও তো ঠিক! তবে এখন পর্যন্ত তো সেই দাদা-ই ডাকো।
- সে তো তোমার জন্য!
- এছাড়া আমার আর কি করার ছিল?
- হ্যাঁ। পালিয়ে গিয়ে বংশের আভিজাত্য বাঁচানো-ই ছিল তোমার সঠিক সিদ্ধান্ত।
- যাইহোক! সাতকাহন গল্পের পর তো এখনও একটা সম্পর্ক টিকে আছে। কথাটা শুনে আঁখির এতদিনের শুষ্ক বাঁকা নয়ন বেয়ে দু-ফোটা অশ্রু টপ-টপ করে ঝরে গেল। স্বাভাবিক ভাবে বলতে চাইল, পরল না। অনেকটা গোঙানির মতো আওয়াজ বের হল গলা থেকে, - আমার অভিমানটা কোনদিন বুঝতে পারোনি তুমি।
- কে বলল সে কথা?
- কেন টুপুর পরতে গেছিলে আমাকে রেখে?
- সেদিন তো তুমি পরিস্কার-ই বলে দিয়ে ছিলে...!
- পেছনটায় কে ছিল! মনে আছে?
- আছে।
- আমি আর মনের প্রলাপ ছড়িয়ে লোক হাসাতে চাই না দিব্যদা। অধরা ব্যথায় আক্রান্ত আঁখি একটু মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলল, - সমাজের মিথ্যে অহমিকায় ভরা আমার দাদা! কেন যে নিজকে এত সংস্কারসম্পন্ন মনে করে। এবার যেন দিব্যর গলাটা কেঁপে উঠল। তবে সেটা ভয়ে নয়! হারানো বিরহে।
- তুমিও তো সায় দিয়ে ছিলে দাদাকে।
- এছাড়া কি করার ছিল আমার!
- প্রতিবাদ করা।
- তোমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অবলা নারীর কণ্ঠে কি এত সাহস আছে?
- পক্ষে একটি মাত্র ধনাত্মক সংকেত দিতে আমাকে, দেখতে কি করি!
- মারডাঙা করতে?
- করতাম।
- লোকে হাসতো! ভালোবাসায় হিংসা...। কথা বলে আঁখির চোখমুখ উদাস হয়ে যায়।
- তুমি রাধার অন্তর, পিঞ্জরে নিয়ে জন্মিলেও... আমিও কিন্তু কৃষ্ণর মতো প্রভাস নদীর পারে বসে আছি এখনো...।
- ছাড়ো না গো বিরহ! কি আর হবে এসব ভেবে। আমার তো ঠিকানা-ই বদলে গেছে।
- হ্যাঁ। তুমি তো মায়ের তকমায় রঞ্জিত হয়ে গেছো। পৃথিবীতে এই একটাই সম্পর্ক আছে সব সম্পর্ককে ফিকে করে দেওয়ার জন্য।
এবার মৌনতা আকড়ে ধরে আঁখিকে। বিষ্ময় না আকুলতায় ছেয়ে গেছে, বুঝা গেল না। প্রলাপ সুরে বলতে লাগল দিব্য, - আমিও চাই না.... মা সম্পর্কটা কোনো দিন পৃথিবীতে কুলোষিত হোক। সহজ পৃথিবীর জটিল করা নিয়মানুযায়ী তো, ভুলটা সবসময় পুরুষদের-ই হয়! এই কলঙ্কটা আমারই থাক! অশ্রু পান করতে শিখে গেছি এখন। চোখের জল ছাড়া সমাজের সমস্ত ভার বইতে পারি।
- হ্যাঁ গো। মেয়েরা তো কেঁদে হালকা হয়, লোকসমক্ষে। পাঁচমিশালি আহা-উহু তাও পাওয়া যায় শ্বান্তণা স্বরূপ! তাতে যদিও দুঃখ কমে না। কিন্তু সমব্যথী ধরে নেয়া যায়। অথচ পুরুষদের এমন এক যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে রাখে 'সময়', যেন কাঁদাটাও লজ্জার। ওদেরও মন আছে, স্বাভাবিক কান্না আছে এটা মনে-ই থাকে না। মানসিক নির্যাতনে পুরুষরাই বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আঁখির কথা শুনে অজস্র দুঃখের মাঝে পুলকের ছোঁয়া পেল দিব্য। কেমন জানি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁখি আবার বলতে লাগল, - মৌনব্রত ভেঙে ফেলো। বেশি চুপ থেকো না! তোমার কথা মতো বেনারসি পড়েছিলাম ঠিকই। ভেবে না তাতে তুমি 'দোষী' এটাই আমাদের ভাগ্য ছিল। আজ যে অবতারের পূজা করছি! গোপনে তুমিই তো ঢেলে দিয়েছো হাতে ফুল।
দিব্য পুরুষ হয়েও ভুলে গেছে, সে পুরুষ; বাউল হয়ে ভুলে গেছে তার স্বরূপ। না হলেও কি দুচোখ একসাথে ভেঙে গলে যেত! বাউল ধর্মে কারো প্রতি কোনো খেদ থাকতে নেই। তবুও কেন জানি আঁখির বারবার মনে হচ্ছে, দিব্য পথ ভ্রান্ত...!! প্রশ্নটা করবে কি করবে না, না ভেবেই সুধালো, - আজ একটা সত্য বলবে?
- কি গো?
- আমারে সংসারি বানিয়ে তুমি কেন বাউল হলে!
- ওঃ, সে-কথা! উত্তর জানা প্রশ্নটা করে কেন লজ্জা দিচ্ছো।
আঁখি নীরব হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। বিনয় ভরা বিলাশিতার হাসি দিয়ে বলে, - ইজ্জত! সেটা বাঁচাতেই তো এখনো দাদা বলে ডাকি...। নাহলে তোমার সঙ্গী হয়ে চলে যেতাম সাধন মার্গে। কথাটা দিব্য না শুনলেও অনুমান করতে পারল। মনে মনে বলল, - তোমার ওজন এত বেড়ে গেছে যে; আর পারছি না! বুকে নিয়ে বইতে...।
0 মন্তব্যসমূহ