দুর্ভেদ‍্য সত‍্য

✍️ শুভ্রা দেব

মেঘ ও বৃষ্টির লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই শরৎ আর হেমন্ত কিভাবে কেটে গেল। নদীর ধারে কাঁশফুল গুলি ও প্রাণ হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে। এবার শীতের আমেজ নেওয়ার পালা। মেঘ বৃষ্টির অভিমান যেন মিটল এবার । কিসের যে এতো মান - অভিমান ছিল ওদের। আগরতলার পরেই ধর্মনগর; দীপাবলির সময় নানা রঙের ঝাড়বাতি আর  আলোর রোশনাই এ আলোকিত হয় গোটা শহর আর মেতে উঠেছিল শ‍্যামা মায়ের আরাধনায়। ভোরবেলা থেকেই অঝোর বৃষ্টিতে, স‍্যাঁতস‍্যাঁতে রাস্তাঘাটে  দীপাবলির আমেজটাই হয়েছিল পুরো মাটি। ধর্মনগর মিশন রোডের কোয়ার্টারে থাকে মাহি আর নিখিল। নিখিল পি. ডব্লিউ.ডি অফিসে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। ঘড়িতে সকাল সাতটা, রবিবার হওয়ার দরুণ অফিস বন্ধ। হালকা শীতের ছোঁয়া লাগতেই ঘুম যেন ভাঙতেই চাইছেনা ; কাজের তাড়নায় তবুও বিছানা ছাড়তে হবে। সবাইকে ঘুমে রেখেই, মাহি যথারীতি দিনের কাজ শুরু করে দিল। মনটা বড্ড কেমন করছে, কারণটা নিজেরই অজানা। কাজের ফাঁকেই মন যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে; বারবার অন‍্যমনষ্ক হয়ে পড়ছে। সকালের কাজ প্রায় শেষ। মনোরঞ্জনের জন্য একটু মুঠোফোনে ফেসবুক ঘাটছে। বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসল। প্রোফাইল ঘুরতে গিয়ে দেখা গেল তালা ঝুলানো। সচরাচর মাহি সব রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেনা। হঠাৎ কি মনে হলো রিকোয়েস্ট টা এক্সেপ্ট করে নিল।
                       তারপর ফোন রেখে আবার শুরু হলো নিত‍্যদিনের রুটিন। মাহি একটা প্রাইভেট অফিসে কাজ করে। করোনাকালীন সময় থেকে ঘরে বসে অনলাইনেই কাজ। কাজের ফাঁকে মেসেঞ্জারে এক আধটু কথা হয় বন্ধুদের সাথে ব‍্যস এভাবেই চলে। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই দিন কেটে যায়। হঠাৎ নজর পড়ে নতুন ঐ প্রোফাইলের মেসেজ। গুডমর্নিং এর একগাদা ফটো উয়িশ আসতো রোজদিনই। মন ধরলে লাইক ইমোজি দিতো নয়তো না। 
                        আবৃত্তি করতে মাহি বরাবরই খুব ভালোবাসে; কবিতা অন্ত প্রাণ। একদিন দেখলো অচেনা ঐ একাউন্ট থেকে একটি কবিতার পোষ্ট, কবিতাটা পড়ে বেশ লাগল। তারপর উৎসাহ  নিয়ে পুরোটা প্রোফাইল ঘুরে দেখতে লাগল-- অনেক স্বরচিত কবিতার ফোয়ারা। কবিতা গুলি বেশ বাস্তবমুখী। প্রতিটি লাইনের শব্দের সঙ্গে  নিজেকে কেমন মিশিয়ে নিতে লাগল। আর যার কলম থেকে শব্দের ফুলঝুড়ি ঝড়ছিল, তার প্রতি মনটা ভীষণ দুর্বল হতে থাকল; কথা বলার একটি তীব্র বাসনা জাগতে লাগল। একদিন সাহস করে মেসেজ পাঠিয়েই দিল " আপনার কবিতা গুলো বেশ ভালো লাগে পড়তে। " এইভাবে কিছুদিন কথা হয়, তারপর আবার হঠাৎ থেমে যায়। অফিস আর ঘর সংসার সামলিয়ে কবিতা পড়ার নেশাটা বেড়ে গেল।
                        
                            দীর্ঘদিন পর আবার মাহি ঐ অচেনা একাউন্টে মেসেজ পাঠায়। সেই থেকেই বইতে শুরু করল কথার ঢেউ। যখনই সময় হতো কথা চলতো। এভাবে কেটে যায় মাস চারেক। ওরা যেন একে অন‍্যের পরিপূরক হয়ে উঠল; যাইহোক না কেন শেয়ার না করলে কেমন অধরা থেকে যায়। ছন্দস্রোতে ভেসে ঘনিষ্ঠতা প্রবল থেকে প্রবলতর। অবিবাহিত প্রবীণ মনে কেবল ঘোর অশনি সংকেত; বিবেকের দংশনে বিদ্ধ কোমলমতি হৃদয়। এই পথে আর নয়, ধ্বংসযজ্ঞের অবসানে-- হতে হবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু প্রতিবারই প্রচেষ্টায় ব‍্যর্থতার করাল থাবা। অজানা অনুভূতির টানেই বারবার ফিরে আসা। ছোটবেলা থেকেই মাহি যেই ছবি এঁকে কাগজের পর কাগজ ছিঁড়ে গেছে, সেই মানুষটাকে আজ যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে ঐ অজানা মানুষকে ঘিরে   ; অন‍্যদিকে তাকেও বিচ্ছেদ গ্রাস করতে চলছে ভেবে-- সে যেন  কেমন উন্মাদপ্রায়। তবুও সৃষ্টির পথে ধ্বংসলীলা সাঙ্গ করতে এই বিচ্ছেদ চিরমঙ্গলময়। মাহি পাগলের মতো হয়ে উঠছে, বাঁচামরা যেন সমান। প্রাণ থেকেও নিষ্প্রাণ দেহ। কেন এমন হচ্ছে, কিসের জন্য এতো মরিয়া? আবেগ - ভালোবাসা;  কি এই সম্পর্কের নাম? যাকে কোনোদিন সামনে দেখেনি, স্পর্শের উর্দ্ধে যার অবস্থান ; যার বাস্তব উপলব্ধি নিশুত রাতে দেখা স্বপ্নসম ; তারজন‍্য কেন এই ব‍্যকুলতা! উত্তর মেলা ভার।  ঈশ্বরের কি লীলা! -- মাহি ওরা ক'দিনের জন্য বেড়াতে গেল দীঘা সমুদ্র সৈকত দেখার উদ্দেশ্যে। ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ শরীরে অদ্ভুত শিহরণ ; কি দেখল নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। মুখোমুখি এক দুর্ভেদ‍্য সত‍্যের। সেই চোখ, মুখ, দীর্ঘদিনের তপস‍্যা-- যাকে একবার সামনে থেকে দেখার, তার বাস্তবায়নকে মানতেই পারছেনা মাহি, বারবার চিমটি কাটছে নিজেকে, সত‍্যতা যাচাই করার জন্য। 
                         হঠাৎ বিকট আওয়াজ শোনে-- উঠে বসতেই চোখে- মুখে জল ছিটকে পড়ল। নিখিল, মাহির উঠতে দেরী দেখে মজার ছলে জল ছিটাতে লাগল। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে জলে ভেজা মুখ নিয়ে আরও কাঁপতে কাঁপতে নিখিলকে জড়িয়ে ধরল আর ডুবে গেল ভালোবাসার অনাবিল স্রোতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ