শিখল ভাঙার সুর


                  ✍️ শ্যাম মালাকার 

গ্রামের নাম কলিমপুর । মুসলিম প্রধান গ্রাম । গ্রামে কর্তা ধর্তা মৌল্লা মুরুব্বিরাই । গ্রামে একটি মাত্র স্কুল আর সেখানে মেয়েদের তেমন আনা গোনা নেই বললেই চলে , তবে নয় বছরের সুরাইয়াকে তবুও তার আম্মু সাকিনা বেগম ঐ স্কুলে ভর্তি করে দেয় । কারন সাকিনা বেগম কলকাতা শহরের মেয়ে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স গ্র্যাজুয়েট, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে women studies এ M.A। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের চাপে M.A পাস করার পরই মুর্শিদাবাদের কলিমপুর আরেক রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে জুবেদ আলির সাথে বিয়ের বাঁধনে পরে যাই সাকিনা বেগম । তাই আর তার পড়াশোনা করা হয়নি। শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন টা তার অধরাই থেকে যায় । যে সাকিনা একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের কে হিজাব নামক কূপ্রথার বিষয়ে সজাগ করতো , সভা সমিতি করতো , বিয়ের পর সেই তাকেই পড়তে হয়েছে হিজাব । প্রথম প্রথম সাকিনা এর প্রতিবাদ করলে স্বামী জুবেদ আলি ও শ্বাশুরি জুলেখা বেগমের অত্যাচারের চাপ এতটাই বেড়ে যাই যে তাকে মেনে নিতে হয় সে খাঁচাই বন্দি এক অচিন পাখি । সাকিনা তাই চাইনা তার মেয়ে এই রক্ষণশীল সমাজের একজন হয়ে উঠুক তাই সে নিজে সব অত্যাচার সহ্য করেও মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় । মেয়ের স্কুলে ভর্তি নিয়েও স্বামীর সাথে কম লড়াই করতে হয়নি সাকিনাকে । 


সালটা তখন ২০২২২ তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর । নয় বছরের সুরাইয়া সেদিন ঘরে টিভি দেখছিল । হঠাৎই সুরাইয়া বলে ওঠে আম্মু আম্মু দেখবে আসো টিভিতে কী দেখাচ্ছে। পাশের রান্না ঘরে রান্না করছিল সুরাইয়ার আম্মু সাকিনা বেগম । ছুট্টে গেলো মেয়ের কাছে । 

সাকিনা বেগম -- কী হয়েছে তোমার আম্মু । 

সুরাইয়া -- আম্মু দেখো টিভিতে দেখাচ্ছে ইরানের একটি মেয়ে কে সেখানকার পুলিশ মেরে ফেলেছে । 

 মেয়ের মুখে এই কথা শুনে হতবাক হলেন সাকিনা বেগম । তিনি ইরানের হিজাব বিরোধী মাহশা আমিনীর লড়াই এর কথা শুনেছেন টিভিতে । কিন্ত মেয়ের মুখে এই কথা তার হৃদয়ে দাগ কাটলো । 

সাকিনা বেগম -- কেনো আম্মু কেনো মেরেছে ! মেয়েটা নিশ্চয়ই বদমাইশি করেছিল ! 

 সুরাইয়া -- না আম্মু মেয়েটা বদমাইশি করেনি । মেয়েটি ভূতের মতো ঐ কালো পোশাকটা পড়বেনা বলেছিল । আর ওটা রাস্তায় পুড়িয়ে দিয়েছিল । তার সাথে অনেক মেয়েও ছিল । তারা মাথার চুল কেটে ফেলে দিয়েছিল । আচ্ছা আম্মু মেয়েটা কী কোনো দোষ করেছিল ? তুমিযে ঐ কালো রঙের পোশাকটা পরো ওটা আমারও পরতে ভালো লাগে না । আমিও যদি ওটা পরবোনা বলি তবে কী পুলিশ আমাকেও মেরে ফেলবে আম্মু ? 

সাকিনা বেগম -- না না আম্মু আমি তোমাকে কিছু হতে দেবো না , তুমি যে আমার কলিজার টুকরা , তুমি যে আমার শিখল ভাঙার সুর ।

সাকিনা বেগম অবসর সময়ে মেয়েকে পশ্চিম ভারতের পণ্ডিতা রমাবাই, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষ্মী ও বাংলার বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রমুখী বসু , রাসসুন্দরী দেবী , নাগেন্দ্রবালা মুস্তাফী ইত্যাদি ঊনবিংশ শতকের মেয়েদের জীবনের গল্প শোনাতেন। দিনটি সেদিন ১৭ অক্টোবর ২০২২ , সুরাইয়ার বাবা জুবেদ আলি ঘরে টিভি দেখছিল । হঠাৎই সে তার স্ত্রী সাকিনা ও মেয়ে সুরাইয়াকে ডাকে । দুজনেই সেখানে যাই ।

জুবেদ আলি - দেখো সুরাইয়ার আম্মু টিভিতে মন দিয়ে খবরটা দেখো । কর্ণাটকের মুসকান হিজাব পরবে বলে জান প্রাণ দিয়ে লড়াই করছে । আর তুমিই কী না সারাক্ষণ এটা খারাপ ওটা খারাপ করে আমার মাথাটাই খারাপ করো । দেখো দেখে কিছু শেখো একটু আর মেয়েকেও শেখাও । হিজাবি মাইয়া তৈরী করো , ওসব পড়াশোনা চুলোয় যাক । মেয়েকে আরবি পড়াও , কোরান পড়াও । ওসব ফিজিক্স কেমিস্ট্রি , হিস্ট্রি পড়ে কোনো লাভ নেই । মেয়েকে আল্লালহের ইবাদত করতে শেখাও ।    

সাকিনা বেগম-- সুরাইয়া আম্মু আমার তুমি একটু বাইরে যাও তো তোমার আব্বার সাথে আমার কিছু কথা আছে । 

সুরাইয়া চলে গেল , তখন স্বামীর মুখের উপর বলে ওঠে সাকিনা বলে ওঠে ।

সাকিনা বেগম--- ওসব করে কি আর ডাক্তার তৈরি হওয়া যায় ? আমি আমার আব্বা আম্মুর কারণে আমার জীবন নষ্ট করেছি তোমার সাথে বিয়ে করে । বিয়ের আগে বলেছিলে যে-- "বিয়ের পর আমাকে পড়তে দেবে " । যেদিন থেকে এই বাড়িতে আসলাম সেদিন থেকে তুমি আর তোমার আম্মু আমার স্বপ্নটাকে কেড়ে নিয়ে আমাকে নিজেদের দাসী করে রেখেছো । আমি চাই না আমার মেয়ে কারোর দাসী হয়ে থাকুক । আমার মেয়েকে আমি- ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, হিস্ট্রি আর সাইন্সই পড়াবো । যা করার আছে করো ভেবো না আমি আর চুপ করে থাকবো । আমার সাথে যা করেছো করেছো । আমার মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ছেলে খেলা করার চেষ্টা করলে তোমার আম্মু আর তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াবো । এই বলে রাখলুম ।

জুবেদ আলি --- সাকিনা বড় বড় কথা হয়েছে তোমার তাই না । ( এই বলে সাকিনার গালে চড় কষিয়ে দেয় জুবেদ আলি ) । বড় বড় কথা শুধু । আমি চললুম মাঠে অনেক কাজ আছে , ধান গুলো সব পড়ে আছে । মাইয়ারে দেখো 

 ছোট্ট সুরাইয়া মন দিয়ে খবরটা দেখেছিলো । দেখছিলো মুসকানের লড়াকু চরিত্র, দেখছিলো তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন । জুবেদ আলি চলে গেলে সাকিনা বেগম তার মেয়েকে আড়ালে জিজ্ঞেস করে করে --

সাকিনা বেগম -- আম্মু তুমি বড় হয়ে কার মতো হতে চাস। ইরানের সেই মাহশা আমিনীর মতো না কী কর্ণাটকের মুসকানের মতো ?

সুরাইয়া--- আম্মু আমি কাদম্বিনীর মতো ডাক্তার হতে চাই আর , মাহশা আমিনীর মতো প্রতিবাদী হতে চাই । আমি মুসকান হতে চাই না আম্মু , আমি মুসকান হতে চাই না । মুসকান হলে যে ঐ ভূতের মতো কালো রঙের পোশাক টা আমাকে পড়তে হবে । আমি কাদম্বিনীর মতো সাদা জামা পড়া ডাক্তার হবো আম্মু। 

সাকিনা বেগম-- ( সুরাইয়ার কপালে চুমো এঁকে দিয়ে ) হ্যাঁ আম্মু তুমি ডাক্তার হবেই হবে । আমি যা পারিনি তুমি তা করবে ।

সাকিনা বেগম তার মেয়ে সুরাইয়া কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে বলতে লাগলো আমি কখনোই তোমাকে এই ঘৃণ্য কুসংস্কারগ্রস্থ সমাজের একজন হতে দেবো না আম্মু । তুমি যে আমার কলিজার টুকরা । তুমি যে আমার মুক্ত আকাশের পাখি , মুক্ত বাতাসের গান ,আম্মু তুমি যে আমার শিখল ভাঙার সুর । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ