✍️অপর্ণা সিনহা
ঝাঁটা দিয়ে ঘর সাফ করতে করতে গৃহিণী হঠাৎ শুনতে পেলেন তীক্ষ্ণ স্ত্রী কন্ঠের ভৎর্সনা!
- আরে আরে কি রে ! চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি?
গৃহিণী প্রশ্ন করে,
কে? কে বলছেন? তাছাড়া আপনি আমাকে তুই তুকারি করে বলছেন কেন?
স্ত্রী কন্ঠ বলে,
আঃ মরণ ! তুই তুকারি করে বলবো না তো কি পূজা করে বলবো, দেবী সম্বোধনে?
গৃহিণী আবারও বলে,
আচ্ছা ঠিক আছে। যাই সম্বোধন করুন। কিন্তু আপনি কোথা থেকে কথা বলেছেন ? আর তাছাড়া এটা যে আমার বাড়ি!
স্ত্রী কন্ঠ অসহিষ্ণু হয়ে,
মরণ আমার! তোর বাড়ি তো আমি কি করবো? তাতে আমার বাড়ির দোষ কোথায়? বলা নেই, কওয়া নেই, তুই যে আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলি! পোড়ামুখী!
গৃহিণী এবার খুব রাগান্বিত হয়ে বলে,
আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।এক তো আমার ঘরে আছেন লুকিয়ে তার উপর… .
কথা শেষ হতে দিলো না স্ত্রী কন্ঠ, চেঁচিয়ে উঠলো
বলি চোখের তো মাথা খেয়েছিস! দেখছি তোর মধ্যে মায়া মমতার বিন্দু বিসর্গও নেই। না হলে, একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর এমন সর্বনাশ করতে পারে কেউ?
গৃহিণী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
আমি কি করলাম? সেটাই তো বুঝলাম না!
স্ত্রী কন্ঠ গজগজ করতে করতে বলল,
বুঝবিও না! বলি, এই আকাশ,বাতাস সব কিছুই কি তোর? এই পৃথিবীর সব কিছুতেই কি শুধু তোদের অধিকার? আমরাও তো এই পৃথিবীরই জীব। তবে আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলেছিস কোন আক্কেলে শুনি?কে দিলো এই অধিকার তোকে?
গৃহিণী হতবাক! বলল,
আপনার বাচ্চা? কোথায়? কখন মারলাম আমি?
স্ত্রী কন্ঠ নাকি গলা ভারি (কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল),
দেখ্ ! ঐ নীচে পড়ে আছে আমার বাচ্চারা! তাদের ঝাঁটা মেরে প্রথমে নীচে ফেলে দিয়েছিস। তার পর পায়ে মাড়িয়ে চলে গেলি তুই ! ভালো হবেনা তোর বলে রাখলাম।দেখিস! হায় হায় বাছারা আমার..!
গৃহিণী তখনই দেখতে পেল,একটি সাদা গোলাকার পিন্ড। বড় বড় মাকড়সার বুকে আটকে ধরে রাখতে দেখা যায় এমনি একটা।এটাই যে দেওয়ালে বসে থাকা প্রাণীটির বাচ্চারা, গৃহিণীর আর বুঝতে বাকি রইলো না। এমন হিংস্র ভাবে, মাকড়সাটি পাগুলো উঁচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তাতে গৃহিণী কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,
কিন্তু,আমি আমার ঘর সাফায় করছি। আপনাদের আমি দেখতে পাইনি। তাছাড়া কোন আক্কেলে ঘরের কোণে এমন বৃহৎ জাল পেতেছিলেন?নিজেই দেখুন কত আবর্জনা করেছেন।ওতে তো অনেক কীট পতঙ্গ আটকে মরে আছে। দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না ঘরে।
স্ত্রী কন্ঠ আবারও বলে
আচ্ছা! দুর্গন্ধ পাচ্ছিস তুই?আরে ওতে আমার সারা বছরের খাদ্য মজুদ ছিল!এক লহমায় সব শেষ করে দিলি? তুই রাখিস না খাদ্য? সারা বছরের জন্য তোরা মানুষেরা ঘোলা ভরে ধান,গম,আলু পেঁয়াজ রাখিস না বুঝি? তোর বর কি প্রয়োজনের বেশি টাকা মজুদ রাখেন না ব্যাঙ্কে? পৃথিবীর মাটি,জল দখল করে তোরাই তো চাষবাস করে সব নিজেদের জন্য রাখিস?ফ্রিজ ভরে শাক সবজি মাছ , রাখিস না? সেটাতে দোষ নেই ! আমি আমার সন্তানের জন্য সামান্য কটা কীট পতঙ্গ রাখলে অপরাধ হয়ে যায়? তোদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়।জানিস কত কষ্টে তিল তিল করে জাল বুনে সেগুলো আটকানোর ব্যাবস্থা করেছিলাম আমি। মাগী নিজের বেলায় ষোল আনা বুঝিস।তোরা মানুষেরা অন্য কারও ক্ষুধা তৃষ্ণা ,কষ্ট কখনও বুঝিস না!
হতবাক গৃহিণী কথা বলতেই পারছিল না।
তাকিয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে!ভাবলো,শেষে কিনা এই ক্ষুদ্র জীব তাকে তর্কে হারিয়ে দেবে? কিছু তো বলতেই হবে ভেবে,বললো
তোমার ঐ বিশ্রি জালে দেখো,কী সব আটকে আছে!মৃত চপা কীট, এছাড়া লাশের সাথে সংসার করছো তুমি। তুমি ছাড়া আরও দুটো তোমার মতো জীব ওতে। তার একটা জীবন্ত। একটা মৃত । তবে মৃত জীবটাও তো তোমার মতোই। এত কী তোমার খিদে? নিজের প্রজাতিও ? ছিঃ!
স্ত্রী কন্ঠ রাগে দুঃখে
(ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে) কেন?তোরা রাখিসনি অতিরিক্ত জমা? অতিরিক্ত সম্পর্ক? আমি সব জানি। দেখিও! আমার সাথে সতীপনা দেখানোর দরকার নেই। তবে শুন্ ,আজ যেমন অতিরিক্ত ঝঞ্ঝাট ভেবে ধ্বংস করে দিলে আমার সংসার; কাল একজন তেমনই তোদেরকেও অতিরিক্ত ঝঞ্ঝাট ভেবে ছেঁটে ফেলে দিবে এ গ্রহ থেকে!
গৃহিণী হতবাক হয়ে বলে
মানে কি? কি বলতে চাইছো তুমি?
কখন যে তর্কেতর্কে গৃহিণী আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে সে টের পায়নি।
স্ত্রী কন্ঠ বলে,
মানে কিছুই না। তোরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব ভাবিস তো নিজেদের। একদিন তোদের লোভ,আগ্রাসী মনোভাব, অন্য জীবেদের প্রতি অসহিষ্ণুতা, অতিরিক্ত জমানোর নেশার পাপ, এই সব কিছুর জন্যেই পতন হবে তোদের এই সভ্যতা!
গৃহিণীও ছাড়বার পাত্রী নন,সে বলল,
তোমার মুখের কথায় নাকি? জানো কত মজবুত আমাদের ঘর? আমাদের (কথা থামিয়ে দিয়ে,)
স্ত্রী কন্ঠ বলে,
তোদের! তোদের কি? তোদের সম্পর্ক গুলো কি ততটা মজবুত? যেমনটা তোদের বাসস্থান? যে, প্রকৃতির শক্তি,তান্ডবকেও ভয় করিস না? এত স্বার্থপরতা, লোভ বিশ্বাসঘাতকতা তোদের রক্তে ! ধ্বংসই হবি তোরা!
গৃহিণী নিজেকে সামলে বলে,
সে না হয় হলো। কিন্তু ঝাঁটা মেরে আমাদের ধ্বংস করে, এমন কি কেউ আছে?
স্ত্রী কন্ঠ বলে,
আছে ! আছে বৈকি। তোদের জন্যই তো পৃথিবীটার আজ এই অবস্থা। তোদের জন্যই বন্যা,খরা, তোদের জন্যই শ্বাস বায়ু দূষণ। তোদের জন্যই তো আমাজন শেষ হয়ে গেল। তোদের জন্যই সুনামির তান্ডব।এই ধ্বংসের দাবানল থেকে একদিন তোরাও মুক্তি পাবিনা!
গৃহিণীও
(রেগে গিয়ে বলে) ওওও অভিশাপ দিচ্ছ আমাদের ! হা হা হা হা ! মানুষদের?এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবদের? তোমার তো সাহস কম নয়? তোমার মতো একজন পরজীবী তুচ্ছ কীট!(বলে হাসতে থাকে গৃহিণী)
স্ত্রী কন্ঠ সাথে সাথেই বলে,
হ্যাঁ,দিচ্ছি তো অভিশাপ!তবে তার জন্য নয় । তোদের ধ্বংস তোদের কর্মেই হবে।
গৃহিণী ভাবলো, এত তুচ্ছ, ক্ষুদ্র কীটের (সামান্য এক স্ত্রী মাকড়সার) আজেবাজে কথা শুনছে কেন সে? তার তো, এতো সময় নেই। তাছাড়া তর্কে এর কাছে হেরে যাওয়ার চেয়ে … … .! কিছুক্ষণ ভেবে মনে মনে ভাবলো,
ঠিকই তো! তার অজান্তেই মেরে দিলেই তো সব শেষ! যেমন ভাবা তেমন কাজ! হঠাৎই ঝাঁটা শক্ত হাতে ধরে, দিল এক প্রহার! সাথে সাথে দেওয়ালে বসে এতক্ষণ অভিসম্পাত বর্ষণ করতে থাকা স্ত্রী চরিত্রটি লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে! মনুষ্য গৃহিণী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো! আর এক কুটিল হাসি হেসে সংসারে মন দিল।
0 মন্তব্যসমূহ