দ্বিতীয়া

 
 
 শ্যাম মালাকার ✍️

পত্রের প্রথমে জানাই- 
    রাজমাতা ভোজবালা কুন্তীর চরণে 
      আমার বিনম্র প্রনাম ।
আমার পরিচয় আপনার চোখে - 
   হস্তিনাপুরের বুকে কালো ছায়া। 
হে মাতা আপনার দ্বিতীয় পুত্রের স্ত্রী সত্য - 
    প্রথম হয়েও আমি আজ  দ্বিতীয়া ।
আমি রাক্ষস কূলের রাজকন্যা ,
   হিড়িম্ব ভগীনি হিড়িম্বা ।
সেদিন ভ্রাতা হিড়িম্বর ক্ষুধার তরে
  ঐ গহীন অরণ্যে জননী আপনাদের কাছে 
     আমার সেদিন ছুটে আসা - 
কিন্তু আর্যের সিংহের মতো দৃপ্ত পৌরুষ, 
 -কঠিন চেহারার দ্যুতিময়তা
  দেখে তাসব  ভুলে - 
    প্রথম দর্শনেই আমি 
 আর্যের প্রেমে হয়েছি মত্ত ।
আপনার পুত্রের মন হরণের তরে- 
 আর্যবর্তের রমণীর বেশবাস ছেড়ে - 
তখন রাক্ষুসী এই অরণ্যবালিকা  
     দিব্যবস্ত্রে সজ্জিতা । 
কিন্তু সে তো বাইরের রূপ।
   অন্তরে তখনও আমি অরণ্যবালিকা। 
আমার মোহিনী রুপের মুগ্ধতায় 
  চোখের চোরাস্রোতে বীর বিকোদর - 
কামিনীকাঞ্চনের নেশায় পড়েছিল । 
মোর  বুনো রূপ তখন  প্রেম কামনায় ছিল মত্ত , 
 আর তাইতো আমার চোখের চোরাটান সেদিন 
  ভাসিয়া ছিল আপনার পুত্র 
 ভারতশ্রেষ্ঠ পাচক বীর বল্লভ  ।।
আমি যত  এগিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে - 
    আমার চলার ছন্দে,
  আর অপ্সরাসম শরীরী লাস্যে - 
আপনার দেবোপম পুত্র হয়েছিল মত্ত । 
প্রিয়কে সামনে পেয়ে, 
  প্রেমিকার চোখে-মুখে যে লজ্জা ফুটে ওঠে,
মাতা আর্য কে দেখে - 
 এই অরণ্যনন্দিনী হিড়িম্বার
  চোখে মুখে সেদিন ফুটেছিল
  কামেশ্বরের কামিনীকাঞ্চন । 
আমাকে দেখে বুক তাঁর হয়েছিল  উথাল-পাথাল। 
  এ প্রেমাবেগ শুধু একান্ত আর্যের বলা ভুল ।
আপনার কূলের বধু রুপে আমি প্রথমা। 
    কিন্ত আপনার শর্তের কারণে 
আজ আমি কূলবধু রুপে দ্বিতীয়া ।
 যেদিন ভ্রাতা হিড়ম্ব কে পরাজিত করে 
রাক্ষস কূলের নিয়ম মেনে 
    আর্য  হয়েছিল রাক্ষস কূলের অধিপতি।  
সেদিন নিয়মের বাঁধনে যখন 
আপনার পুত্রকে  দিতে হবে - 
   রাক্ষস রাজকন্যার গলায়  
    বিবাহের জয়মালা ।
তখন বিবাহের জন্য এলো - 
   শর্তের অমোঘ নিয়মের পালা ।
হে মাতা আপনি দিলেন  প্রথম শর্ত এই বলিয়া - 
 "হে অরণ্যবালিকা  পারিবেনা তুমি  
 কখনো কূলবধুর অধিকার নিয়ে - 
করিতে হস্তিনাপুরে প্রবেশ ।
কারণ রাক্ষস কূলের কন্যা 
হতে পারে না আর্যবর্তের রাজঘরনী ।"
এর পর দ্বিতীয়  শর্ত রাখিল 
   জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃতুল্য ভাসুর ।
 তথা আপনার প্রথম পুত্র -
    ধর্মরাজ জুধিষ্ঠীর ।
আমারে কহিলেন ধর্মরাজ - 
হে রাক্ষস কূলের রাজকন্যা - 
" তোমার কূলের আরাধ্যকে সাক্ষী রেখে 
   বচন দাও মোরে ,
 বিবাহের পর তোমার গর্ভে যে জন্মিবে - 
সে সন্তান দাবি রাখবেনা- 
    হস্তিনাপুরের সিংহাসনে । 
কারণ সে সন্তানের ধমণীতে - 
 আর্যবর্তের রুধি প্রবাহিত হলেও , 
নাড়ির বাঁধন থাকবে রাক্ষস কূলজাত। " 
  মেনে নিলাম এ দুই শর্ত- 
এরপর তৃতীয়ে শর্ত দিলেন স্বয়ং- 
    পবন পুত্র বীর বিকোদর ভীম । 
আর্য আমার শর্ত দিলো , বলিলেন - 
 "হে লস্যাময়ী অরণ্যবালিকা- 
    বিবাহের এক বৎসর পর 
মোদের সন্তান জন্ম নিলে ,
 এই রাক্ষস কূলের সিংহাসন 
 আর রাজকন্যা সহ তার পুত্রকে
আমি ত্যাগ করিব ।"
ভ্রাতা হিড়িম্বর মৃত্যুর পর -
  রাক্ষস কূলের মান-সম্মান ,
 আর  সিংহাসনের নিয়ম রক্ষার্থে - 
মেনে নিলাম এই শর্তও নিঃশর্তে- । 
রাক্ষসযোনিতে আমি রাজকন্যা জেনেও 
    কুলবতী কন্যাদের মতো - 
আপনার পুত্র  বলেছিলো মোরে 
   ওহে প্রিয় ‘ভদ্রে' তুমি মৃগ নয়না। 
সিংহের মতো তুমি  ‘তন্বঙ্গী’ ।
আমার মধ্যদেশ মত্ত হয়ে - 
 মোর স্বামী  বলেছিল "সুমধ্যমা' মোরে ।
হে রাজমাতা আপনারই কূলবধু আমি , 
কলাবতী আর্যরমণীদের সঙ্গে -
   আপনার দৃষ্টিতে আমার তফাৎ অনেক। 
আমি রাক্ষস কূলের রাজকন্যা ,
   হিড়িম্ব ভগীনি হিড়িম্বা ।
আমার পরিচয় আপনার চোখে - 
   হস্তিনাপুরের বুকে কালো ছায়া । 
  হে মাতা  শিশু কালে শুনেছিনু - 
জন্মের পর ললাট লেখন 
সৌভাগ্যের ঐ ত্রিদেবীদ্বয় - 
দেবী ধাতা -বিধাতা ও নিয়তি ।
হে রাজমাতা , দেবী ধাতার কৃপাবলে -
   রাক্ষস কূলের রাজকন্যা হয়েও 
 আজ আপনারই কূলের বধু আমি ,
জননী বিধাতার কৃপাবলে আমি আজ 
আপনার সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী সত্য,  
 কিন্ত আপনার দ্বিতীয় পুত্রের স্ত্রী রুপে 
        আমি দ্বিতীয়া ।
জননী বিধাতার কৃপাবলে আমি আজ 
    এই হস্তিনাপুরের রাজনন্দিনী ।
 কিন্তু  দেবী নিয়তির খেলাঘরে আমি আজ - 
       কূল ও কোল শূন্য অভাগীনি । 
আমার পুত্রের অধিকার ছিল - 
    এই হস্তিনাপুরের সিংহাসনে । 
তা তো ধর্মপুত্র কেড়ে নিয়েছিল , 
 তাহলে কেনো ঐ 
ছলনাময়ীর কৃষ্ণের ছলনায় - 
   আপনার গান্ডিবধারী পুত্র কে রক্ষার্থে- 
আমার মতো নীচ কূলের জননীর 
   কোল শূন্য হতে হলো ? 
এই হস্তিনাপুরের সিংহাসনে -
আমার পুত্রের অধিকার ছিল ।
    কিন্ত সিংহাসনের বদলে সে 
    বীরগতি পেলো।  
আপনিতো কখনই আমাকে বলেননি 
    আপনার সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী ।। 
দেননি কখনো আপনার 
   কূলের কূলবধু মান সম্মান। 
তবে কেনো আপনার দৈবস্বত্ব কোল ও কূল বাঁচাতে - 
 আমার কূলের শ্রেষ্ঠ প্রদ্বীপ
 বারবরিক কে দিতে হলো আত্মবলিদান ? 
হিমালয়ের পাদদেশে, দেবদারু ঘেরা 
ঐ অরণ্যের নন্দিনী আমি । 
  আপনি গভীর তপস্যায় মগ্ন হয়ে 
মন্ত্রবলে আবারও স্বামী ছাড়া
  দেব ঔরসে সন্তান জন্ম দিতে পারেন ।
মাতৃত্বের সুখ নেওয়ার পর - 
সমাজের লোক লজ্জার ভয়ে -
    তটিনী তরঙ্গে তাকে
  উজার করে দিতে পারেন ।
কিন্ত আমি তা পারি না ।
  কারণ বন্য হলেও আমি কূলটা নই। 
হে রাজমাতা আমি আপনার মতো 
    উচ্চ কূলজাত ভোজবালা না হলেও ,
নিজের সতীত্বকে আমি -
স্বামী ছাড়া কোনো দৈব্য পুরুষের কাছে 
         সমর্পণ করি নাই । 
আমি রাক্ষস কূলের রাজকন্যা হলেও 
      পুত্রের কামানায় স্বামী ছাড়া - 
পর পুরুষের পরশ গ্রহণ করি নাই । 
   বন্য হয়েও আজ নিজেকে 
আমি ধন্য মনে করি । 
   কারণ আপনার সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী ,
ঐ পাঞ্চাল কন্যা পাঞ্চালীর 
   মান আবরু হরণের প্রতিশোধ যজ্ঞে - 
আমার কোল আর কূল - 
   আজ দুটোই শূন্য । 
আপনি তো পাঁচ মানিকের  মাতা ,
আমার কোলেতো  ছিল একটিই মানিক । 
  সেও আপনার পাঁচ মানিকের মধ্যণি -
ইন্দ্রপুত্র অর্জুন কে বাঁচাতে -
  সূর্য পুত্রের দ্বারা প্রেরিত 
 দেবরাজ ইন্দ্রের একাঘ্নীতে 
যমের চরণে নিজকে দিয়েছে অঞ্জলিতে ।
   আমার পুত্রবধু  অহিল্বতি 
    আপনার আর্যাবর্তের সাম্রাজ্ঞী - 
ধ্রুপদ দুহিতা দ্রৌপদীর থেকেও অভাগিনী ।
      সে তার স্বামীকে দিয়েছে 
  ধর্ম পুত্র যমের দুয়ারে বিসর্জন, 
বাঁচাতে আপনার যোগ্য পুত্রবধুর 
 সিঁথির গৌরব ও মান ।
    আমার কূলের তিন প্রদ্বীপ 
আমার পুত্র বধুর বুকের ধন ,
   আমার চোখের চাঁদ মানিক 
পৌত্র আমার অঞ্জনপর্বন - 
    মেঘবর্ণ আর বারবরিক ।
আপনার কূল বাঁচাতে তারা হয়েছে- 
  নিজ মাতা অহিল্বতি  কোল শূন্য  ।
ব্রজধামের ঐ নন্দের দুলাল ,
 যশোদার বুকের ধন - 
  বাঁকা কৃষ্ণ কানাই এর কালা যাদুতে 
   যুদ্ধ শেষে আপনার 
কূলের দীপক ছিল বেঁচে - 
  বিরাট কন্য উত্তরার উদরে।  
আমার কূলের দীপক তখন 
   ঐ বসু নন্দন বাসুদেবের বাঁশির বশে- 
মৃত্যুপুরী যমের দুয়ারে ছিল বসে । 
শত আত্মত্যাগের পরেও - 
 আমি, আমার কূল আজও 
  আপনার কারণে - 
সমাজের কাছে বন্য । 
 হে রাজমাতা ভোজবালা কুন্তি - 
আপনি আর আপনার কূলের শ্রী ধন্য ।
 পত্রের শেষে আবারও জানাই- 
    রাজমাতা ভোজবালা কুন্তীর চরণে 
রাক্ষস কূলের রাজকন্যা ,
  হিড়িম্ব ভগীনি হিড়িম্বার বিনম্র প্রনাম ।
আমার পরিচয় আপনার চোখে - 
   হস্তিনাপুরের বুকে কালো ছায়া । 
হে মাতা আপনার দ্বিতীয় পুত্রের স্ত্রী সত্য - 
   প্রথম হয়েও আমি আজ -
          " দ্বিতীয়া ।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ