শিক্ষকের মান

 শিক্ষকের মান
 শ্রী রিপন সিংহ ✒️


আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ..। আমি ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার আব্বার নাম আযীমউদ্দিন আহমেদ;আব্বা একজন কলেজ শিক্ষক। আমার আম্মা আমি যখন পাঁচ বছরে ছিলাম তখন আমায় ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে যান। আমি ছোটবেলায় খুব পেটুক ছিলাম,আব্বার মুখে জানতে পারলাম আমাকে একবার আম্মা কোন এক বিয়ের নিমন্ত্রণে নিয়ে যায়,সেখানে আমি নাকি তিন দল উঠে গেলেও আমার খাওয়া শেষ হয়না। ১৯৫৫ সালে আমি পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করি এবং ১৯৫৭ সালে ব্যাগের হাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চাধ্যমিক পাস করি। আমার এই প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ ছিল অনন্য। তখন আমাদের অর্থনীতির ক্লাস নিতেন রমেশ চন্দ্র সেন,তিনি এমনভাবে ক্লাস করাতেন যে সমগ্র বিশ্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরতেন! এর পর ওনি অশ্বারোহীর মতো জ্ঞানের বাণ ছুঁড়তেন। আমরা সবাই হা...করে স্যারকে তাকিয়ে থাকতাম। অন্য কোন ক্লাসের স্যার যদি না আসতেন,তবে আমি স্টাফ রুমে গিয়ে রমেশ স্যারকে ক্লাসে আসার জন্য অনুরোধ করি,স্যারতো নয় সাক্ষাৎ মনের মতন বন্ধু। আমি ঠিক করে নিলাম যে,আমি ভবিষ্যতে অর্থনীতি নিয়ে পড়বো। রমেশ স্যার অঙ্গ - ভঙ্গ করে এমনভাবে ক্লাস করাতেন যে আমি বাড়িতে একটু পড়লেই বুঝেনিতাম। আমার মতে অর্থনীতি হল পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বিষয়। রমেশ স্যারের ডিগ্রি ছিল সাধারণ BA (Economic)। হঠাৎ আমাদের দেশে মুসলিম লীগের হাহাকারে আমাদের প্রিয় রমেশ স্যার কলকাতায় চলে যান। কয়েক দিন পর আমাদের নতুন অর্থনীতির ক্লাস নিতে এলেন ড.রমজান মিঞা(B.Com,M.Com,P.hd) ওনার ক্লাস করে আমার মনে হল যে পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে বিষয় হল অর্থনীতি। আমি ভাবলাম আর অর্থনীতি নিয়ে আমি পড়বো না। মৃদুল স্যারের বাংলা সাহিত্য পড়ানোর ভঙ্গিমা দেখে আমি অতি উৎফুলিত, স্যারের সাহিত্য চর্চা দেখে আমাকে মুগ্ধ ও পাগল করে দিয়েছে। স্যারতো নয় সাক্ষাৎ ভগবান। স্যার যখন ক্লাসে সাহিত্যের কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে, স্যার নিজেই সেই বিষয়ের চরিত্র হয়ে যেতেন। মনে মনে স্থির করলাম সাহিত্যের সাথেই জীবন কাটাবো। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া শেষ করি এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। ১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে শিক্ষকতার জীবন শুরু করি। কয়েক দিন পর আমি কিছুকালের জন্য সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করি। এরপর সরকারি বিজ্ঞান কলেজে দু - বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করি। কয়েক মাস পর আমি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগে যুগদান করি। আমি সাহিত্য চর্চায় আমার জীবনকে বিলিয়ে দিলাম। তৎকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আমি ষাটের দশকে বাংলায় সাহিত্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। কিশোর - কিশোরীদের নিয়ে আমি কণ্ঠস্বর পত্রিকা সম্পাদনা করি,এরপর ধীরে ধীরে ১৯৭৮ সালে পনেরো জন ছাত্রকে নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করি। সভাপতি হলেও সবার সহযোগিতায় বাংলাদেশে একটি সর্বাঙ্গীন জীবন - পরিবেশ গড়ে তুলার চেষ্টা করি। এখন কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় পনেরো লক্ষ্য ছড়িয়ে।
     কিছুদিন পর আমি আমার এক আত্ময়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায়, সেখানে আমার কথাবার্তা শুনে ওখানকার লোকেরা আমায় জিজ্ঞেস করে,
"আপনার পেশা কী? মানে, আপনি কি কোন সরকারী চাকরী করেন?
"হুম্ , আমি আমার পেশাটা হল বেয়াদবী পেশা।
এখানের একজন অবাগ হয়ে জিজ্ঞেস করল,আরে কি বলেন আপনি! বেয়াদবী পেশা মানে?
"হেসে বললাম আমি কলেজ শিক্ষক,আর শিক্ষকতা মানেইতো বেয়াদবী।
আমরা,মানে শিক্ষকরা নিজের সমতুল্য পেশা ছাড়া - এমনকি অন্য কোন উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিকেও স্যার বলি না, আমরা স্যার শুনি। তাই আমার মতে শিক্ষকতা হচ্ছে একটি বেয়াদবী পেশা। হেসে হেসে বলি, আমরা কোনোদিন কাউকে সালাম দেই না - আমরা সালাম গ্রহণ করি। আমাদের পেশা হল বিশ্বের সমস্ত পেশাকে তৈরি করা।
যত বড় অফিসার,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাষ্ট্রপতি - প্রধানমন্ত্রী সবই লিকলিকে শিশুর মতন আমাদের পায়ে এসে পড়ে।এটা আমাদের অভিমান নয়, এটা আমাদের প্রাপ্য - সম্মান। 
"ওহ.. তাতো ঠিক!
তাইতো আপনার কথার ধরন সবার থেকে আলাদা!
তোমার পরিচয়? আমি আইএএস অফিসার আবুলের ছেলে। আমি হেঁসে উঠলাম, আপনি হাসলেন যে? আরে তোর আব্বা আমার ছাত্র। আবুলতো আমার হাতে অনেকবার মারও খেয়েছে। ওই দুষ্ট চাকরি পেয়েই তার আব্বা - আম্মার কাছে না গিয়ে আমার কাছেই প্রথম এসেছিল মিষ্টি নিয়ে।
আবুলের ছেলে হা.. করে তাকিয়ে রইল!

     আমি একদিন সাহিত্য কেন্দ্রে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সভাপতি আসন অলংকৃত করি। গিয়ে দেখি বাহ্ কি আয়োজন, আমি হেসে হেসে বলি,আমার সামনে থেকে এই মাইক্রো ফোনটা ছড়াও।
"কেন স্যার? আমাদের কি কোন ভুল হল!
"নাহ্ , তবে আমি পরে বলবো।
আমি মনে মনে ভাবি সভাপতি মানেই দুনিয়ার লোকের বক্ বক্ ভাষণ শুনে শেষে দু -এক কথা বলে অনুষ্ঠান শেষ করা। দু - ঘণ্টা পর সভাপতিকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলো। আমি দাঁড়িয়ে মাইক্রো ফোনটা হাতে নিয়ে হেসে হেসে বললাম, তোমরা আমাকে প্রথম থেকেই অপমানিত ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেছো। তোমরা আমার বসার টেবিলের সামনে ছোট্ট একটা মাইক্রো ফোন রেখেছো, আর এতে ধরেই নেওয়া যায় যে, সভাপতি এতই বৃদ্ধ হবে যে উঠে আর বলতে পারবে না! আর দ্বিতীয় বৈষম্যটা হল আমাকে দিলে এক - দুশো টাকার পাঞ্জাবি আর প্রধান অতিথি সামিন বেগমকে দিলে তিন হাজার টাকার দামের জামদানি শাড়ী। সবাই হাসতে হাসতে পেট ধরতে লাগলো।
" আমার শরীর খুব খারাপ,তাই আমি আজ খুব ঠেকে ঠেকে কথা বলবো।
"কারণ উত্তাপ নাই,বাড়িতে এত সুন্দরী থাকার পরেও উত্তাপ নাই। 
আমি বললাম, বক্তৃতা বললেই হয়না, সবাইকে আকর্ষিত করতে হয়। মানসিকতা জাগ্রত করতে হয়।
"মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।"
এইভাবে দু - এক কথা বলে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করলাম। 
অনুষ্ঠান শেষ করে গাড়ি নিয়ে বাসায় রউনা হই। শুনতে পেলাম কোন এক আসামি নেশা দ্রব্যসহ অনেক বেআইনি অস্ত্র মজুত করে অন্যদেশে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাই সবার - সমস্ত গাড়ির চেকিং হচ্ছে। চারিদিকে ট্রাফিক পুলিশ আর সার্জেন্ট। আমি কোন রাস্তা দিয়ে যায়, কারণ আমার ইন্সুরেন্স বা বীমা এক সপ্তাহ আগেই শেষ। আমি বিকল্প এক রাস্তা দিয়ে চললাম, ভাবলাম এখানে কোন পুলিশ থাকবে না। আর আল্লাহর কি দয়া পুলিশতো আছেই সঙ্গে হেড ডি.এস.পি.ও দাঁড়িয়ে আছে; ডি এস পি অফিসার কোন ত্রুটি পেলেই ফাইন নিচ্ছে, লাঠি চার্জ করছে। 
"আজ আমার মানসম্মান শেষ।"
আমরা শিক্ষক,আমাদের ত্বকতো পাতলা। ডি এস পি বিশাল দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সে আমার দিকে আসতে লাগলো, আমি তখন গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে থাকি,মানে যাতে যেন ডি এস পি ' কে তত গুরুত্ব দিচ্ছি না, আমার কোনও অসুবিধা নাই, সব ঠিক আছে। কিন্তু ডি এস পি যেন নাছোড়বান্দা, সে মচ্ মচ্ করে আমার দিকে আসতে লাগলো, সে যতই আমার কাছে আসছে আমার প্রকৃতি দেখা বেড়ে যায় আর হৃদপিণ্ড ঢুক ঢুক করে লাফাচ্ছে। কিন্তু যখন তের পেলাম যে আমার পিঠের কাছে তার নিশ্বাসের শব্দ তখন আর প্রকৃতির দৃশ্য দেখা যায় না। তখন আমি ভয়ে হাত - পা কেপেকেপে আসতে করে তার দিকে তাকালাম। ওরে বাবা মুহূর্তের মধ্যে এক বিপ্লব ঘটে গেল, সেই বিশাল উচ্চপদস্থ ডি এস পি চিহিহি করে চেঁচিয়ে উঠল " আস - সালাম - আলাইকুম স্যার। আমার পায়ে পরে গেল,আমি অবাগ! স্যার কেমন আছেন? বাসায় সবাই ভালো তো,আমায় আশীর্বাদ করেন স্যার, আপনার জন্যই আমি আজ এই পদে আছি। তার হাত - পা কাঁপতে লাগল।

মানে তার দাঁত - পাত - হাত এতবড় অফিসার সব কোথায় ধুলিশা, যেন একটা কাদামাটি আমার পেয়ে পরে গেল। কারণ সে যেদিন ছাত্র ছিল তার সামনে আমরা ছিলাম অনেক বড়, ওই যে অল্প বয়সে মনের মধ্যে যে ছাঁপ পড়ে গেছে, সে ছাঁপ আর মুছা যায় না। 
আমি মনে মনে ভাবলাম একজন শিক্ষক হলে চিরদিনের জন্য শিক্ষক, আর একবার ছাত্র হলে সে সারা জীবনের জন্য ছাত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন