✍️ মিলন পুরকাইত
"ওমা এ আবার কি কথা, এখন বিয়ে করবি না মানে?"
অষ্টম আশ্চর্য চাক্ষুস করার মত গোলগোল চোখ করে বলে মিতিনমাসি। সুরে সুর মিলিয়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয় টুকাইদিও। কৌতুকের স্বরে চোখ নাচিয়ে বলে,
"কেন রে, লটঘট কেস নাকি? লাল কার্ড দেখিয়েছে বুঝি কেউ? নাকি এখনও বেকার সে!"
বোঝো কান্ড! কি কথার কি যুক্তি! এইজন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, অনুষ্ঠান, পালা পার্বনে যেতে ইচ্ছে করে না আজকাল রিমঝিমের। দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সব কৌতূহলী মানুষজন। অন্য কোনো কথা নেই ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। 'বিয়েটা কবে করছিস?' যেন সমস্ত পৃথিবী রসাতলে যাবে রিমঝিম বিয়েটা না করলে! কেন রে বাবা আর কথা নেই তোদের। আমি বিয়ে করি বা না করি তোদের কি যায় আসে? আর মাম্মামটাও হয়েছে তেমন। শত্রুপুরীতে একা ফেলে, কোথায় যে চলে গেল কে জানে!
ব্যাজার মুখে বসে মনেমনে এসবই ভাবছিল রিমঝিম। হঠাৎ পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় টুকানদা। মৃদু ধমক দিয়ে বলে মাকে
"আহ মা, ছাড়ো না ওসব। কত বছর পর দেখা হল পুচকির সাথে, কত ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করেছে মেয়েটা। এইটুকু বয়সে কত দায়িত্বশীল পদে চাকরি পেয়েছে,সেসব গল্প নেই! কি এক বিয়ে বিয়ে করে যাচ্ছ তখন থেকে।"
ছেলের ধমক খেয়ে তখনকার মত চুপ করে গেলেও হাল ছাড়ে না মিতিনমাসি। অন্যপাশে সরে গিয়ে গলা মেলায় সমমানসিক দিদি বৌদিদের সাথে।
"বাব্বা তেজ কিগো ওইটুকু মেয়ের! কি বা এমন ভুল বলেছ, বলো তো? এমন করে ফোঁস করতে হবে তাতে?"
সমবেদক কেউ একজন সুর টেনে বলে, অন্যজন ধুয়ো ধরে তালে তাল মিলিয়ে,
"সত্যি বাবা, কলেজ ইউনিভার্সিটি শেষ, তাও বলে কিনা 'এখন বিয়ে করবে না!' ঠিকই বলেছে টুকাই, নিগঘাত কিছু লটরপটর করে রেখেছে মেয়ে তলায় তলায়, দেখো গে যাও।"
"আসলে দিদিরই আদিখ্যেতা যত। ছোট থেকেই মাথায় তুলে নাচছে। কি না লেখাপড়ায় ভালো। তা সে যেমনি হোক, নিয়মনীতি বলেও ত কিছু আছে নাকি সমাজে? সোমত্ত মেয়ে বিদ্যেধরী হয়ে করবেটা কি বলো দেখি? বাপমাকে খাওয়াবে পরাবে নাকি সংসার টানবে? যে বয়সের যা। বুড়ি হয়ে গেলে তখন হাজার হা পিত্তেশ করেও জুটবেনা কেউ,বুঝবে তখন। আমার কি!"
ফোঁস ফোঁস করে বলে মিতিনও। মাসি মাসি করে পায়ে পায়ে ঘোরা মেয়েটা, এমন ঝ্যাক ঝ্যাক করে বলল ওকে। সাদা মনে কাদা নেই বলেই না জিগ্যেস করতে গেছিল, ভালো চায় বলেই না, নইলে ভারী দায় পড়েছে ওর যেচে পরে কারোর হাঁড়ির হাল জানতে।
গোটা পৃথিবীটাই মাঝে মাঝে এজন্য শত্রুপুরীই মনে হয় আজকাল রিমঝিমের। আশ্চর্য মানসিকতা মানুষের। আর আজব যত নিয়ম নীতি সমাজের। 'পঁচিশ পেরিয়ে গেল আর কবে বিয়ে হবে? এর পরে কি জৈলুস থাকবে চেহারায়।' না থাকলেই বা কি? বিয়ে করবে না রিমঝিম। একটা মেয়ে বড় হলেই তার জন্য এই একটাই সীমানা ? একটা ছেলের জন্য এমন ভাবনা পোষণ করে নাতো কেউ?
সেই ছোট থেকেই পরিবারে এই বৈষম্য দেখছে রিমঝিম। শুধু ছেলে বলে সব ভালো জিনিসের ভাগ অনায়াসেই পেয়ে গেছে টুবাই।রিমঝিমের জ্যেঠুর ছেলে। কয়েক মাসের পিঠোপিঠি দুজন। ছোটবেলাটা একসাথেই কেটেছে ওদের। ঠাম্মি দাদু, জেম্মা, জ্যেঠুর সাথেই। দুজন সমবয়সী ছেলেমেয়ের মধ্যে আর কেউ অতটা তফাৎ না করলেও ঠাম্মি করেছে বরাবর। নাতিকে চোখে হারায় কিনা।
টুবাইও পূর্ণ সুযোগ নিয়ে গেছে ঠাম্মির অন্ধ ভালোবাসার। ছোটমোট দোষ করলে নিশ্চিন্তে বোনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দাঁত বের করে নির্লজ্জের মত হেসেছে আড়ালে,ক্যাডবেরি ঘুষ দিয়ে ভাব করে বোনকে বলেছে, "এই শেষবার! রাগ করিস না বনু"।
বলেছে, কিন্তু আড়ালেই, সামনে সেই গুড বয় ইমেজ। আর কিছু না করেও কথা শুনেছে রিমঝিম। কত কথা। মনে আছে একটা কথা প্রায়ই বলত ঠাম্মি "সিস্টি ছাড়া!" রিমঝিম আর পরমা দুজনের উদ্দেশ্যেই ছিল তার সেই এক মন্তব্য।
মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগত ওর। প্রশ্ন জাগত শিশু মনে। নিজে মেয়ে হয়েও শুধু মেয়ে বলে এত দূর ছাই করে কেন ঠাম্মি! হাজার ভালো কাজ করলেও কোনোদিন ঠোঁট ফাঁক করে সুখ্যাত করে না একটা। উল্টে এমন ভাব করে যেন 'এ আর এমন কি!'
পড়ালেখায় ভালো বলে ছোট থেকেই এক রাশ প্রাইজ নিয়ে বাড়ি আসত রিমঝিম বার্ষিক অনুষ্ঠানের দিন। বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতে ওর হাত থেকে সেসব নিয়ে হইহই করে ছুটে যেত টুবাই ঠাম্মিকে দেখাবে বলে । বোনের গর্বে ঝলমল করত ওর চোখমুখ। ঠাম্মি কিন্তু ছুঁয়েও দেখত না সেসব। উল্টে মুখ বেঁকিয়ে বলত," দেখেছ কি বড় মন আমার নাতির। একফোঁটা হিংসে নেই মনে। তা নইলে বোনের প্রাইজ নিয়ে আহ্লাদ করে এত!"
সংসারে বৈষম্যের বীজ বোধহয় এভাবেই বোনা হয়।ছোট থেকেই অতিরিক্ত প্রাধান্য পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে পরে ছেলেরা। অজান্তেই স্বার্থপরও হয়ে যায় হয়ত কিছুটা। খাবার হোক বা জামা, শখ হোক বা প্রয়োজন, সব ভালো তার জন্য হাজির, সব অনিয়মই তার জন্য মুকুব। এমনটাই নিয়ম লাগু হয়ে যায় সেই গোড়ার দিনগুলোতেই। যদিও নিয়ম না বলে অনিয়ম বলাই শ্রেয় তাকে। যে নীতিতে সাম্যতা নয় ভরপুর পক্ষপাতের সায়, সে আবার নিয়ম হবে কি করে?
ছোটবেলাটা তবু একরকম কেটেছে রিমঝিমের, বড় হয়ে ত আরেক জ্বালা! তখন সবে ওর ক্লাস সিক্স।ছুটির ঘন্টা পড়া মাত্র অন্যদিনের মতোই সেদিনও ছুটতে যাচ্ছিল রিমঝিম। টুম্পা টেনে নিয়ে গেল এক ধারে। ফিসফিস করে বলল "তোর স্কার্টটা লাল হয়ে গেছে মৌবনী, শিগগির টয়লেটে চল আমার সাথে।"
কি হয়েছে কিছু না বুঝেই হাউমাউ করে খুব কেঁদেছিল রিমঝিম। চোখ মুখ ফুলে গেছিল কেঁদে কেঁদে। পরে মাম্মাম বোঝাল, অমন নাকি সকলের হয়। মানুষের, ঠাকুরের আসলে সব মেয়েদেরই। এটাকেই নাকি 'বড় হওয়া' বলে। ভয়ের তেমন কিচ্ছু না। মাম্মামের আশ্বাস পেয়ে জ্বর জারির মত একটা স্বাভাবিক অসুখ বলেই মনে হয়েছিল এই চারদিনের অস্বস্তিকর 'শরীর খারাপ' নামের ব্যাপারটা। একবারও মনে হয়নি ও একজন আলাদা কেউ, এমন কেউ, যাকে ছুঁলে পাপ হয়!
গোপালের মিছরি মাখন দুই নাতি নাতনিকে সন্ধ্যেবেলা ভাগ করে দিত বুড়ি। অভ্যেস মত সেদিন যেই প্রসাদ নিতে গেছে তরাং করে ছিটকে ওঠে ঠাম্মি! গজগজ করে কি না বলে, শুধু কি ওকে, ওর মত সিস্টিছাড়া আলুক্ষে মেয়ের জন্ম দেওয়ার জন্য মাম্মামকেও কিছু বলতে বাকি রাখেনি মানুষটা। অন্যায়টা যে ঠিক কি সেটা ভালোভাবে না বুঝলেও অন্যায়ের গুরুত্ব যে অনেক, খিদের পেটে ভালোই বুঝেছিল রিমঝিম। প্রতিবাদে ভূখ হরতাল করেছিল মাম্মাম আর রিমঝিম, দুজনেই টানা দুদিন। স্রেফ জল খেয়ে নেতিয়ে ছিল সারাদিন। শেষে জেম্মা দিব্বি দেওয়ায় খাবার খায় মাম্মাম। আর তার দেখাদেখি রিমঝিমও। বুড়ি অবশ্য তখনও মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, "যত সব নাটুকেপনা! মা, মেয়ে দুটোই সমান নাটুকে !"
অন্যদের মত মিতিনও সেই গতানুগতিক প্রশ্নবাণে মেয়েটাকে এভাবে জর্জরিত করবে ভাবেনি পরমা। তাই নিশ্চিন্তে ওকে সবার মধ্যে রেখে কিছুক্ষণ মায়ের কাছে বসেছিল সুখ দুঃখের গল্প নিয়ে। এর মধ্যে যে এত মহাভারত হবে কে জানত। মেয়ের থমথমে মুখ দেখে না বলতেও সবটা বুঝে যায় পরমা। কি যে পায় ওরা এসব করে। বারবার এক কথা বলে বলে বিরক্ত করে মারে মেয়েটাকে। এটাই মজা যেন ওদের। যেটা নেই সেটার কথা তাই শুধু, আর যেটা অন্য অনেকের নেই, তার বেলা? সেটাও আলোচনা করতে হয়, সমালোচক সমাজকে সেকথা আজ বুঝিয়েই ছাড়বে পরমা স্পষ্ট করে।
মেয়ের হাত ধরে জটলার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায় পরমা। রিমঝিম নয় সেখানে তখন অন্য কারো মুন্ডপাত হচ্ছে একই কায়দায়। প্রমুখ বক্তা যথারীতি সেই হাতে গোনা পাঁচ ছ জনই। বাকিরা শুধুই শ্রোতা।তারা শুধু মুখ বুজে শোনে, তালে তাল ঠোকে দরকার মত।
"আমাদের এক্ষুণি চলে যেতে হবে রে মিতিন। আই এ এস হওয়ার এইত জ্বালা। ইচ্ছে থাকলেও সাধারণ হওয়া যায় না। এজন্যই আসতে চায় নি মেয়েটা । খালি বলছিল ''তুমি চলে যাও একা। আমায় ত ফিরে আসতে হবে যখন তখন।কাজটাই এমন।" আমিই গোঁ ধরে বলেছিলাম "টুকাইয়ের বিয়ে আর তুই যাবি না! তাই হয়! মুখ দেখিয়েই চলে আসবো না হয়। তবু চল। মিতিন কত ভালোবাসে তোকে। দিদুনও। বিয়ের বাড়িতে দেখা হয়ে যাবে সবার সাথে।" এসব বলে ধরে করে নিয়ে ত এলাম মেয়েটাকে।কিন্তু কি হল! মুখ দেখিয়েই ত চলে যেতে হচ্ছে সেই!"
"তা আর কি করবে,মেয়ে কি আর তোমার যেমন তেমন কাজ করে পরমা। এটুকু সময় যে এসেছে সে মেয়ে তোমার কথা রেখে, এই কি কম কথা? কি বলো মিতিন।"
আলোচনার মোড় পাল্টে যায় রাতারাতি। চেনা, অচেনা, সকলের চোখেমুখে যেন প্রচ্ছন্ন গর্ব।
বিয়ে হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না, 'দেখগে যাও নির্ঘাত কিছু ব্যাপার আছে', 'নিজেই ঠিক করে রেখেছে' হয়ত' এসব ফিসফাস পাল্টে গেছে ততক্ষণে।রিমঝিম জানে এখন জোরদার গুঞ্জন চলবে ওর চাকরি, পদমর্যাদা, যোগ্যতা নিয়ে। তা চলুক। আলোচনার শেষে এরাই ত বলবে "ওহ, এজন্যই ত বিয়েটা করছে না মেয়েটা।" বলবেই ঠিক।
চোখে চোখেই হাসে মা মেয়ে নিঃশব্দে। কিছু প্রতিবাদ এভাবেও করা যায় আসলে। যে নিয়মনীতির আড়ে পক্ষপাত হয়ে চলেছে এতদিন, তাকেই তোপ বানিয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রয়োগ করা যায় হয়ত এভাবেই। অন্তত এভাবেই আয়না দেখুক সমাজ। বুঝে নিক ছেলে আর মেয়েদের জায়গাটা আসলে সমান সমান।না বেশি না কম! যোগ্যতাই গুরুত্ব পাওয়ার মাপকাঠি, লিঙ্গ ভেদ নয়।
উত্তর শাসন,শাসন,বারুইপুর,উত্তর ২৪ পরগনা