✒️অনুরাগ ভৌমিক
অন্যান্য শুক্রবারের মতো আজও বেচু বেরিয়ে পড়লো বোতল কুড়াতে। সঙ্গে তার মা। "আজ কই যাইবা মা?"
"চল ঐ ব্রীজটার কাছে। ঐখানে অনেক দিন হইলো যাইনা।নে এই বস্তাটা ল।"
শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ।বাকি ছয় দিন ফুটপাতে,দোকানে দোকানে এটা সেটা কাজ করে, মাঝে মধ্যে চেয়ে টেয়ে কিছু পায়।যা পায় তাই নিয়ে সন্ধ্যার পর চলে আসে শিশুপার্কের উল্টোদিকে যে শপিং মল তার খোলা করিডোরে। অনেক রোদ বৃষ্টি কষ্ট সয়ে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে ওরা থাকছে। মোটামুটি স্থায়ী ঠিকানা।
চাইলেও সবাই দিতে চায়না।শহরের দোকানদার এই যে দুই এক টাকা দেয় তা এবেলা না হলেও ওবেলা কাজ করিয়ে পুষিয়ে নেয়।তবে বিকেলের দিকে গ্রাম থেকে যারা শহরে আসে ওরা ফিরে যেতে কিছু দেয় বিশেষ করে মহিলারা।ওরা ভালো মানুষ। ওদের অনেক কে দেখে দেখে মুখগুলো চেনা হয়ে গেছে বেচুর।
দুপুর বেলা অনেকদিন মহাদেববাড়ি বা আরও দু তিনটা আশ্রম, মন্দির অথবা জগন্নাথ বাড়িতে প্রসাদ পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে সুপার মার্কেটের পেছনে যে সস্তা হোটেল আছে সেখানে খেয়ে নেয়।মালিক ভালো অনেক সময় টাকা রাখেন অনেক সময় রাখেন না। সন্ধ্যার দিকে পথের ধারে যে ফাস্টফুডের দোকান বসে সেখান থেকে চেয়ে রুটি সবজি খায়, সঙ্গে বেশি খায় বাপান্ত গালি। ওদের জল এনে দেয়।জায়গাটা পরিষ্কার করে দেয়।আবার কখনো কখনো টাকা বেশি উপার্জন হলে কিনে খায়।
ফুটপাতে বসে একটা কোণায় ছোট্ট একটা ছেলে বাদাম বিক্রি করে। মাঝে মাঝে ওর বড় ভাই এসে কিছুক্ষণ থাকে । আবার শহরের অন্য কোথাও এমন বাদাম দোকানে চলে যায়।এই ছোট্ট ছেলেটির নাম বিশু।বিশুর সাথে বেচুর খুব ভাব। মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকে সে।দুজনে অনেক কথা বলে।বিশুকে অনেক কাজে সাহায্য করে।বিশু ও বেচু কে বাদাম খেতে দেয়।অনেক সময় বেচু খায় না, মায়ের জন্য নিয়ে যায়।বিশুই বেচুকে খবর দেয় রাতে কার বাড়িতে ঠাকুরের অনুষ্ঠান আছে, খিচুড়ি প্রসাদ আছে।বেচু যায় অনেক অবহেলা পেয়েও প্রসাদ খায়।
ফুটপাতে দোকান সঞ্জুর।কালো ছিপছিপে সবসময় হাসিখুশি চেহারা।একটা ঠেলায় পুরো দোকান।চপ ডালের বড়া,চানা পাপড়,রুটি ঘুগনি, মাংস বিড়িয়ানি ইত্যাদি বিক্রি করে । তার হিসেবে ভালো বিক্রি এবং উপার্জন।এই সঞ্জু ও একসময় ভিক্ষা করতো ,চেয়ে চিন্তে খেতে পেতো।এই শহর সম্পর্কে সে জানে। তখন বেচুর মতো বয়স। বাংলাদেশ থেকে সোজা ত্রিপুরার এই শহরে এসেছে।সে দেশে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এই সঞ্জুদের মতো অসহায় অনেক লোক এসেছে এবং এখনো আসছে।এইসব ঘটনা খুব করুণ।ভাবলে সঞ্জুর এখন ও কান্না পায়।সঞ্জুর সাথে বেচুদের চেনা জানা।বেচু মঞ্জুকে সঞ্জু মামা বলে ডাকে।সঞ্জু ও আপন মামার মতো খবর নেয় তাদের। মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য ও করে।জগতে বেচুর মা ছাড়া আপন এই সঞ্জু মামাই আছে। সঞ্জুর আপন বলতে বৌ আছে, আর একটা মেয়ে, ক্লাস সিক্সে পড়ে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। বিশেষ করে প্রচন্ড বৃষ্টির দিনে ভিক্ষা পায় না,পেলেও নেহাত অল্প। ফুটপাতের দোকানেও বিক্রি কম হয়।তাই ওরাও টিফিন দিতে চায় না। ঐ দিনগুলোতে বাঁচতেই কষ্ট হয়ে পড়ে। নিরুপায় হয়ে একবেলা খেয়ে একবেলা না খেয়ে চলে যায় কোনো প্রকারে। তবু এমন কোনো হাহুতাশ নেই বেচুর। সঞ্জু মামা তাকে মাঝে মাঝে ভরসা দিয়ে বলে,"মামা আর একটু বড় হইয়া যা, তইলে তোরে ঐ বড় মিষ্টির দোকানটাতে একটা কাজ পাওয়াইয়া দেমু।" বেচু খুশি হয়। কিন্তু বড় কীভাবে হয়ে যাবে তাই বুঝতে পারেনা।কখনো একা থাকলে বেচু স্বপ্ন দেখে একটা ঘর ভাড়া নেবে মায়ের জন্য।সে ভিক্ষা করবে না আর,কাজ করে টাকা রোজগার করবে। অনেক টাকা জমাবে। প্রচন্ড কষ্ট পেলে একা একা বেচু কান্না করে। আবার চোখ মুছে ফেলে।স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েদের দেখলেই ইচ্ছে জাগে সে ও যদি স্কুলে পড়তে পাড়াতো খুব ভালো হতো।
আজ শুক্রবার। সকাল থেকে একটু একটু বৃষ্টি।এক পসলা পড়ে তো আবার চুপচাপ।বেচু একাই যাবে বোতল কুড়াতে।মনটাও ভালো নেই। কিছু টাকারও দরকার।গতকাল দুপুর হতেই চম্পার জ্বর জ্বর ভাব।রাতে কিছুই খায়নি।বেচু মাকে অনেক করে বলেছে। কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি।মার শরীর ভালো না থাকলে বেচুর কিচ্ছু ভালো লাগেনা।মনটা কেমন কাতর অস্থির হয়ে ওঠে। শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করে।সঞ্জু মামা তখন দোকান গুটিয়ে বাড়ি গেছে ।এমন সময় বেচু কী করবে ভেবে পায়নি।
যাক রাতটা ধীরে ধীরে সকাল হয়ে গেলো। সকাল বেলা মামা দোকান খুললে বেচু মামাকে কাতর হয়ে বলে। মামা কাছের ঔষধের দোকান থেকে দুটো পেরাসিটামল কিনে দেয়।"বেশি জ্বর হইলে ছয় ঘন্টা বাদে বাদে খাওয়াইয়া দিবি।"
"আইচ্ছা মামা।"
"এই নে এইটা আগে খাওয়াই বি।"এই বলে একটা ব্রিটানিয়া থিন বিস্কুটের প্যাকেট বেচুর হাতে দেয়।
বেচু চলে যাচ্ছে এমন সময় সঞ্জু আবার বলে ,"চিন্তা করিস না,মামা একটু পড়ে চাইয়া আমু।"
বেচু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মায়ের কাছে চলে যায়।
সকাল বেলা সবাই দোকান খোলার আগেই মাকে নিয়ে চলে যায় পেছনের সুলভ শৌচাগারের একটু আগে , এখানে অনেকটা খালি জায়গা। সন্ধ্যার পর মার শরীর ভালো হলে আবার সামনের কড়িডরে চলে আসবে এই ইচ্ছায়।
নাহ আজ এমন কিছু পেলোনা খুঁজে।হতে পারে বেচুর আগেই কেউ কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। খুব খারাপ লাগছে বেচুর। মাঝে মাঝে এমন হয় তবে খুবই কম।এমন হলে তার মা অন্য যায়গায় কুড়াতে যায়।বেচুর মার জায়গা গুলো চেনা আছে।বেচু এই একটা জায়গাই চেনে।জায়গাটা ব্রীজের দিকে।খালি বস্তাটা হাতে মুখে একটা কষ্টের ছাপ নিয়ে ফিরে এলো।মার জ্বরটা অনেকটা সেরে গেছে।মা তারে ডেকে বলে,"বেচু এই নে ইহানে কুড়িটা টাকা আছে।একটু চা রুটি নিয়া আয়।"
দুপুরের দিকে বেচু চলে আসে জগন্নাথ মন্দিরে।আজ ও এক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের প্রসাদ খাওয়ানো হচ্ছে।বেচু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলল "আরোও কিছুক্ষণ দাঁড়া,খাওন ওপুরলে পাবি।"
বেচু বলল"আইচ্ছা,আমি দাঁড়াচ্ছি।"
বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটায় বেচু একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে ভাত ভাল তরকারি একসাথে নিয়ে চলল তার মায়ের কাছে। এদিকে খুব ক্ষিধে পেয়েছে বেচুর।কোন সকালে অল্প বানরুটি খেয়েছে আর এখন প্রায় বিকেল।
বিকেল চারটা পার করে বেচু এসে পৌঁছায় শিশু পার্কের সামনে।হাতে সেই ভাতের প্যাকেটটা ঝুলছে।বেচু হঠাৎ দেখে লোকটি একটা ছোট্ট মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে তার রুটি সবজি চপ চানা ডালের বড়া সাজানো ঠেলা গাড়িটির সামনে থেকে।
আর বলছে,"যা কইতাছি ইখান থাইকা। অহন কিছুই পাইনি না।যা যা কইছি মাথাটা গরম করিছ না।"মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে একটু দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে আছে খাবার গুলোর দিকে। বেচু ঘটনাটা ভালো করে দেখে বুঝে ফেলে ব্যাপার টা কী হতে পারে।
বেচু মেয়েটার কাছে যায়। মেয়েটার ময়লা ও ছেঁড়া জামা,জট বাঁধা চুল,চোখ মুখ শুকনো। দুর্বল।
বেচু জিঞ্জেস করে,"কীরে খাইবি কিছু, ক্ষুধা লাগছে?" মেয়েটির চোখে তখন ও জল।বলে,"হ খামু। কালকের থাইকা কিচ্ছু খাইছিনা।মাও কিচ্ছু চাইছেনা।"
"কই থাইকা আইছত ইহানো?আগে দ দেখছি না।"
"আমরা কাইলকা আইছি ইহানো। বাংলার থাইকা। কয়দিন আগে।পথমে আরেকখানো থাকতাম।মা কইতা পারবো।
" কান্দিছ না।"বলতে বলতে বেচুর ও কান্না পেয়ে গেলো। খুব কষ্টে সংবরণ করে বলে,"এই নে,ইহানো অনেক ভাত আছে।নে ল ইয়া যা।রাত্রে বা কাইলকা সহালে গড়ানো আইচ। আমার মাও থাকবো। আমার সঞ্জু মামা ও আছে।দেখবি খুব যদি হইবো।
মেয়েটা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আনন্দে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে যায়।বেচুও তার নিজের ক্ষুধার কথা ভুলে গেছে। অনেক শান্তি পেলো বেচু কেন সে জানে না, ধীরে ধীরে পিঁপড়ের মতো শহরের ভীড়ের দিকে মিশে গেলো।