-সজীব পাল
বিশেষ কৃতজ্ঞ:সুজন দেববর্মা (পরিবারের তথ্য)
চন্দ্রা দেববর্মা সবেমাত্র বসন্তের শান্ত হাওয়ার আমেজে নিজেকে দেখতে পায়।সে তখন ঊনিশের এক তরুণী ।সে কি জানতো এমন একটা যৌবন জোয়ারের বাতাসের সাথে মিশে যাবে করুণ দিনগুলি ?চন্দ্রার বাবা তমল দেববর্মা দারুণ দীনতার সাথে সংসার চালায়।চন্দ্রার মা বছর চারেক আগে বিষধর বৃশ্চিকদংশনে মর্মবেদনা নিয়ে বীনা চিকিৎসায় প্রাণ হারায়।বাবার হাত ধরেই বেড়ে ওঠা মা মরা মেয়েটা আজ কত বড়ো ।
তমল দেববর্মা ভালো একটা সম্বন্ধ পেয়ে গতবছর চন্দ্রাকে কালিপুর বিয়ে দিয়ে দেয়।ছেলে নামকরা শিক্ষক ছিল,তবে রাজনৈতিক করার কারণে হঠাৎ দলগত পরিবর্তন কারণে রাতে অন্ধকারে বিরোধীদের লাঠির আঘাতে দুই দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। ভগবানের কি নির্মম চিত্র !চন্দ্রা হতভাগি ছোটবেলা মা, বিয়ের পর স্বামী হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
এইদিকে চন্দ্রা আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা,বাবা আগের মতো কাজ করতে পারে না।পরপর দুইটা ধাক্কায় সেও যেন কেমন মরি মরি অবস্থা ।তবুও মেয়ের দিকে চেয়ে বেঁচে আছে আজও ।
চন্দ্রার গর্ভের সন্তান নিয়ে পাড়াগায়ের লোক কটুকথা রটাচ্ছে।কেউ কেউ বলে এই সন্তান চন্দ্রা অন্য পরপুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে সাধন করছে।এই সমাজের নারীরা আরেকটা নারীর বেদনা বুঝতে নারাজ।তারা যেন মানুষ নয় ! কেমন ঈশ্বরের মতো আরেকটা নারীর ভাগ্যে দুঃখ লেখে দেয়।চন্দ্রার যেন এই সমাজ জঘন্য লাগে।
নলুয়া গ্রাম থেকে প্রায় মাইল দুয়েক দূরে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ উপজাতি পরিবার বসবাস করে ।আশির দশকের আগে থেকে।এই স্বল্প বিস্তীর্ন এলাকার একটা নিজস্ব নাম আছে,' নিদয়া'।তারা এতকাল বসতি করেও নিজের অর্থনীতির তেমন জাঁকজমক পরিবর্তন আনতে পারেনি।কোনো মতে নুন এবং পান্তা ভাতে দিন চলে।তারা আজও ঘরের ছাউনি শণের দিয়ে থাকে । তবে তাদের মধ্যে অর্থ কষ্ট থাকলেও অনেক পরিবার শিক্ষা সংস্কৃতি দিক থেকে যথেষ্ট সচেতন।এই গ্রামের অনেক ছেলে মেয়ে নলুয়া স্কুলে পড়ালেখা করে ; চন্দ্রাও সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন ছিল।তমল দেববর্মা এই গ্রামেই।তার ভিটে মাটি ছাড়া জমি আছে চারবিঘের মতো।বিভিন্ন মরশুমে নানা ফসল চাষ করে সংসার চালায় হতদরিদ্র তমল দেববর্মা ।এইদিকে মেয়ের বিয়ের সময় দেড় বিঘার জমি মতো বিক্রি করতে হয়েছে।বিয়ের পর তো সেই মেয়েকে নিজেই চালাতে হচ্ছে ।যদিও তমল দেববর্মার এই নিয়ে বিন্দুমাত্র খেদ নেই।তার ভাবনা "কপালে যদি লেখা থাকে এই পরিনতির ,খণ্ডাবে কে!"
চন্দ্রা শুয়ে আছে,পড়নে রিষা বা পাছড়া(উপজাতি মহিলারা পরিধানের একপ্রকার বস্ত্র) ।তার শরীর ভীষন ক্লান্ত ।সকালে দুই বার বমি করেছে।পেটে একটাও অন্নদানা পড়েনি।তমল সেই ভোরে রান্নার কিছু ছিল না তাই শামুক খুঁজতে বের হয়েছে ; এখনো ফিরেনি।চন্দ্রা ওঠে বসতে পারছে না। আর , উঠলেই মাথা চক্কর দিয়ে চোখ অন্ধকার হয়ে আসে।সে ঢের টের পাচ্ছে তার শরীর আর মন কোনোটাই সঙ্গ দিচ্ছে না ।এমন কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না যাকে বলবে মাথায় একটু জল ঢেলে দিতে।পেটে একটু একটু ব্যথা অনুভব করছে।
এর মধ্যে বাইরে থেকে শব্দ এলো,"মা চন্দ্র কৈ গেলিরে ? একটু জল দে-না মা, ভীষন তেষ্টা পেয়েছে ।"
চন্দ্রা হতভাগি বাবার কথা শুনতে পায় কিন্তু সাড়া দিতে পারছে না ।তার বাক্ স্বাধীনতাও যেন ক্লান্তি হরণ করে নিয়েছে।
তমল দেববর্মা কোনো উত্তর না পেয়ে ঘরে ঢুকে।গিয়েই কপালে চোখ উঠে গেছে। চন্দ্রা শুয়ে আছে হাত পা ছেড়ে । চন্দ্রাকে ধরেই বলল,'মা'রে কি হয়েছে কথা বল!
" বাবা একটু জল দাও"
'দিচ্ছি মা '- তমল মেয়ের মুখে জল ঢেলে দিলো আলতো করে।
' বাবা কথা বলতে পারছি না।শরীর বিবশ হয়ে আসছে।'
'কি হয়েছে বল মা ।কেন বিবশ হয়ে আসছে? '
তমল দেববর্মা ভয় পাচ্ছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কোনো কিছু খেয়ে ফেলেনিতো ! মেয়েটা এই বয়সে যা কষ্ট পেয়েছে এইরকম কাজ করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
'জানি না বাবা , সকালে বমি.......'
কথা শেষ না করতেই তমল বলল ,থাক আর বলতে হবে না '।
চন্দ্রার বাবা তমল দেববর্মা পাশের ঘরের কাকাতো ভাই বঙ্কুশ দেববর্মাকে খুঁজতে গেলেন।মেয়েকে ডাক্তার থাক পরে ,আগে অন্ততপক্ষে নলুয়া বাজারের আনাড়ি ডাক্তারের থেকে ওষুধ এনে খাওয়াতে হবে।কিন্তু ওষুধ আনবার একটা কানাকড়িও নেই ঘরে।তাই বঙ্কুশের থেকে একশো টাকা ধার করতে হবে।না জানি মেয়েটা কত কষ্ট পাচ্ছে ।বাবার অর্থ কষ্ট দেখে ব্যথার কথা বলছে না।
তমল বঙ্কুশকে ঘরে পেলো না।তাকে না পেয়ে অসহায় পিতা ছোট ভাইয়ের বউয়ের কাছে হাত পাততে একটুও দ্বিধাবোধ করলো না ।যে পরিস্থিতিতে তমল দাড়িয়ে আছে এখন সম্মানের চিন্তা করলে হবে না । একজন বাবার কাছে সম্মানের চেয়ে বড়ো হলো সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ।
তমল বঙ্কুশের স্ত্রীকে বলল,' নয়নতারা একটা সাহায্য করবে আমাকে বোন?
'কি সাহায্য দাদা ?'- বঙ্কুশের স্ত্রী বলল।
'আমার মেয়েটা বিছানা থেকে উঠতে পারছে না ।তাকে যদি এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে না নিই তাহলে বড়ো একটা কিছু হয়ে যাবে।দাও না বোন একশোটা টাকা ধার! বিকালে রক্ত বেঁচে হলেও শোধ করে দেবো।'- তমল দেববর্মা জল জল চোখে বলল।
বঙ্কুশের স্ত্রী কিছু বলার আগেই পেছন থেকে তমলের বৃদ্ধা কাকি বলে উঠলো," খবর্দার একটা টাকাও ছোঁয়াবি না বউ।নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন । মরোক ওই রাক্ষসী! জন্মের পরে মা , বিয়ের পর স্বামীকে খেলো।ধীরে ধীরে সবাইকে খাবে এই রাক্ষসী ।"
'আস্তে বলুন কাকিমা ।মেয়েটা শুনলে কষ্ট পাবে।ভীষন অসুস্থ সে।'
'কেন আস্তে বলবো কেন? মরোক ওই ডাইনি।গর্ভে নাকি আবার সন্তান ।ওই পাপের কারণেই এখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে ।'
তমল দ্রুত পদচারণা করে বের হয়ে গেল।সে স্থির করলো ওষুধ দোকানির কাছে ভিক্ষা চাইবে।তার আগে মেয়েটাকে আরেকবার দেখে নিই কি করছে।এইদিকে তার ক্ষুধার তীব্র জ্বালা ।
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মুখে ভেসে উঠলো তমলের কালবৈশাখীর হাসি।এই হাসি কতটা শোকের ছায়া নেমে আসলে ফুটে ওঠে মুখে তা একমাত্র বাবাই জানে।যে মেয়ে এতক্ষণ বসতে শক্তি নেই ,এখন দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।
চন্দ্রা গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছে।যেখানে এতক্ষণ শুয়েছিল সেখানে পরে আছে কাগজ কলম।সে কাগজটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেছে ।পাশের ঘর থেকে সবাই আসে।বঙ্কুশের স্ত্রী তমলের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে ।তাদের ভাষায় লেখা আছে,
'বাবা আমার জন্য তোমাকে আর বারে বারে চোখের জল আর মানুষের কথা শুনতে হবে না।আমি চলে যাচ্ছি মায়ের কাছে ।আমাকে ধরে ইচ্ছে মতো কাঁদো ,যতক্ষন না তোমার চোখের নদী শোকে শুকায় ।' ইতি তোমার আদরের চন্দ্র
লেখক পরিচিত - লেখক সজিব পাল জন্ম 2000সালের 20 জানুয়ারি বাঁশ পুকুর নামে একটি ছোটগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবই কবিতা গল্প থেকে লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় ।পরে কালক্রমে ধীরে ধীরে ফেসবুকের মাধ্যমে লেখার বহিঃপ্রকাশ ।"মনন স্রোত " ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা "দীর্ঘপ্রতিক্ষা" তারপর সময়ে আরো প্রকাশ হয়।তার সাথে 'নবোণ্মেষ ' প্রথম গল্প "আধার সময় ",'।সৃষ্টি' (নলুয়া) এবং 'আগন্তুক "(পশ্চিমবঙ্গ) ইত্যাদি ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখক হিসেবে যুক্ত ।কবিতার চেয়ে গল্পের প্রতি বেশি অনুরাগ ছিলেন উনার। তাঁর জীবনের সবটা জুড়ে গল্পের আওতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন