-রঞ্জিৎ বিশ্বাস
বর্তমানের এই বৈশ্য তথা পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রিত সমাজে যদি প্রাচীন মুণি-ঋষিরা বেঁচে থাকতেন তবে তারা অবশ্যই বলতেন – 'সবার উপরে মানুষ সত্য,/ তাহার উপরে বেকারত্ব !' হ্যাঁ, আজকের বিশ্বে 'বেকারত্ব' একটা বিষাক্ত সত্য ও জটিলতর সমস্যা। দেশে, রাজ্যে, শহরে, গ্রামে সর্বত্র কিছু থাক বা না থাক বেকার বিরাট আকার ধারণ করে আছে । আর তা দিনকে দিন ৫জি গতিতে বেড়ে চলেছে । যে গতি বর্তমান ভারতে সবচেয়ে বেশী । অর্থাৎ বর্তমান মোদী জামানায় ভারতে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দা চরম বিপজ্জনক আকার ধারণ করেছে । যা সম্প্রতি সাবেক আরবিআই-এর গভর্নর রঘুরাম রাজন স্বীকার করে বলেছেন, ভারতের বর্তমান সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বেকারত্ব । তাছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা তথা বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট জানিয়েছে, নোটবন্দি ও জিএসটির ফলে ভারতের আর্থিক আরও সংকটময় পরিস্থিতিতে । তাছাড়া আরও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে, রাষ্ট্র সংঘের শ্রমবিষয়কসংস্থা "International Labour Organization' (ILO) "World Employment and Social Outlook"
-Trands - 2018 (WESO) শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেন-- এ বছর ভারতে বেকার যুবক যুবতীদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১.৮৬ কোটি এবং ২০১৯ সালে ওই সংখ্যা হবে ১.৮৯ কোটি । গতবছর (২০১৭) শেষে দেশে মোট ১.৮৩ কোটি বেকার ছিল । তাছাড়া ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারতের বেকারত্ব বেড়েছে ৬.১ শতাংশ । গত ৪৫ বছরে যা রেকর্ড । দ্য ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে-এর সমীক্ষা বলছে, নোট বন্দির পর ভারতে বেকারত্ব বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে । প্রসঙ্গত, ভারতের বেকারত্ব নিয়ে Bm¡Qe¡ হচ্ছে আর ত্রিপুরা রাজ্যের কথা কি ভুলে গিয়ে পাপ করতে পারি ! না, LMe¡C না। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে "Fifth Annual Employment Unemployment Survey, Ministry of Labor and Employment, Govt. of India"- ¢lf¡VÑ j¡a¡hL ভারতে বেকারের হার সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে আমাদের এই ত্রিপুরা !এই রাজ্যের প্রতি ১০০০ জনে ১৯৭ জন বেকার সব মিলিয়ে বর্তমানে সমগ্র ত্রিপুরাতে সাত লাখের বেশি বেকার । অর্থাৎ, প্রাক্তন সিপিআইএমের আমলে বেকারের যে অবস্থা ছিল বর্তমানে বিজেপি সরকারের আমলে তার অবস্থা আরও করুণ ও দিশাহীন হয়ে আছে । আইএলও এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়-- "গোটা বিশ্বে বেকারত্ব বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে যত দ্রুত কর্মক্ষম মানুষ বাড়ছে তার সঙ্গে তাল রেখে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না ।" আইএলও-এর মহাপরিচালক বলেন-- "বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। এই পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতি এবং যথেষ্ট কর্মসংস্থানের জন্য অশনিসংকেত । এছাড়া এতে গুণগত কর্মসংস্থান হুমকির মুখে ।" বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিনিধিগণ কর্মসংস্থান না হওয়া ও বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাকে দায়ী করলেও এই বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা প্রভৃতি জটিল সমস্যার মূলে জন্মদাতা যে একমাত্র পুঁজিবাদ তা কিন্তু আজও তারা স্পষ্টীকরণ করেননি । তাই আজ আমাদের বিশ্ববাসীকে সুস্পষ্টভাবে জেনে রাখা উচিত এই যে বেকার সমস্যা, নৈতিক অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক-সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও মানবতার অবমূল্যায়ন উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে এর জন্যে দায়ী একমাত্রমানবতাবিরোধী পুঁজিবাদ । মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের টিকিয়ে রাখতে বেশি সংখ্যক মানুষের রক্ত চুষে সঞ্চিত অর্থ বলে সমাজের সব অংশের মানুষের বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা সবকিছু কিনে নিচ্ছে আর এভাবেই সে সবাইকে গোলামে পরিণত করছে । মূল সূত্রটা হচ্ছে, পুঁজিবাদ আগে অর্থ ছিটিয়ে সার্বিক সমস্যা তৈরি করে রাখো আর বেশি হলে সমাধানের নামে একটা নমুনা দেখাও তারপর আবার অর্থ ছিটিয়ে সমস্যা তৈরি করে চলেছে পুঁজিবাদীরা । এরা লাভ ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না । তাইতো এই বছরেও ভারতের প্রথম ধনীতম ব্যষ্টি মুকেশ আম্বানিই হলেন । যে শুধুমাত্র জিও ব্যবসার দ্বারা ৪১০ কোটি ডলার এখন পর্যন্ত সঞ্চয় করেছেন ! আর এই জন্যই বুঝা প্রয়োজন যে, পুঁজিবাদীরাই সবকিছু চালাচ্ছে । যেকোনো দেশের সরকার তার অঙ্গুলিহেলনে বসে ও চলে । আর তাইতো দেখতে পাচ্ছি, ধুরন্ধর দলীয় রাজনীতির সরকাররা পুঁজিবাদের দালালি করতে গিয়ে দেশের মূল প্রাণশক্তি যুবকদের অবস্থার চাপে ফেলে প্রথমে বেকারে পরিণত করছে তারপর যুবকরাও তাদের বেকারত্বের জ্বালা মেটানোর আশায় পার্টিবাজি করে, চিটিংবাজ এর ফাঁদে পড়ে এবং অপরাধমূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে । আইএলও এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,-- "চাকরি না পেলে অল্প বয়সীদের মধ্যে নিরর্থকতা ও অলসতার তৈরি হয় । অপরাধ, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, সহিংসতা ও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ায় ।" হ্যাঁ, প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে, আজ দেশের কিছু বেকার কর্মসংস্থান পেলেও তাদের সাময়িক কিছু অর্থের টোপ দিয়ে একপ্রকার গোলামে পরিণত করা হচ্ছে । কারণ, দেখতে পাই বেকারদের যথার্থ যোগ্যতা যে বিষয়ে সেদিকে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে অন্য দিকে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে । সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, দেশের কোন কর্মসংস্থান যদিও হয় তাতেও তাদের বাঁচার স্থায়ী গ্যারান্টি আজ নেই । কেননা আমরা দেখতে পাচ্ছি, বছর বছর কিভাবে শিল্পকারখানা বন্ধ করে ও কোন ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই লাখ-লাখ নিযুক্ত কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে । সাম্প্রতিক কালে তো ভারতের অবস্থা খুবই ভয়ঙ্কর ।অর্থাৎ, মারুতি সুজুকি ৩ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করলো । গত ১৯ বছরের সবথেকে কম গাড়ী বিক্রি হওয়ার ফলে প্রায় ১৫ হাজার কর্মী কাজ হারিয়েছে বলে জানান ভারতে গাড়ী প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর সংগঠন সিয়ামের ডাইরেক্টর জেনারেল বিষ্ণু মাথুর । তাছাড়া দেশের বৃহত্তম বিস্কুট প্রস্তুতকারী কোম্পানি পারলে ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করতে চলছে । সাথে ফুড ডেলিভারি সংস্থা জোমাটো ১০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । তাছাড়া কম্পিউটার নির্মাতা সংস্থা hp ৯ হাজার কর্মী ছাঁটাই করতে চলছে । আর সবচেয়ে বড় চিন্তার যে, ভারতীয় রেল অন্তত তিন লাখ লোককে ছাঁটাই করতে চলছে ও বিএসএনএল বন্ধের জন্যে প্রায় ২ লাখ কর্মচারী কর্মহীন হতে যাচ্ছে ! সম্প্রতি, যোগী রাজ্যেও কর্মরত হোমগার্ডের চাকরি থেকে ২৫ হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে । এবার ভাবুন, দেশের বর্তমান কর্মসংস্থানের অবস্থা কি ভয়ঙ্কর ! মানে, ভাত দেওয়ার মুরদ নাই কিল মরার গোঁসাই বর্তমান বিজেপি সরকার । দেশে এতে করেই দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে । আজ দেশের ধুরন্ধর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে 'বেকারত্ব' একটা শক্ত ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে । একে কেন্দ্র করে বার বার সরকারের গদিতে বসতে গলা ফাটিয়ে বলা হয় তারা আসলে নাকি দেশের বেকারত্ব একেবারে দূর করে দেবে, বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করবে, তাদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু শেষে সবগুলো অশ্ব ডিম্ব প্রসব করে । মানে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি হচ্ছেও না । না হলে কেন সারা বিশ্বে বেকারত্ব বিপজ্জনকভাবে দিন দিন বাড়ছে । সুতরাং এগুলো পুঁজিপতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিতান্তই চরম ভন্ডামী ও কপটতা । তবে কি বিশ্বের জটিল সমস্যা বেকারত্ব দূরীকরণের কোন স্থায়ী সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই ? না, অবশ্যই আছে । আর তা হল স্থানীয় মানুষের ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থানের নীতি বা ব্যবস্থাই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রথমেই এক একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করে সেই অঞ্চলে জনগণের ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে । আর এই ওই অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দ্বারা নোতুন নোতুন ব্লকভিত্তিক শিল্প তৈরীর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব । তবে সাথে সজাগ থাকতে হবে যে, যেহেতু পুঁজিবাদ তার মারাত্মক অর্থনৈতিক শোষণ টিকিয়ে রাখতে বিশ্বজুড়ে স্থানীয় অর্থনীতিকে শোষণ করছে এবং লাগামহীন অর্থের বহিঃস্রোত করছে তাই প্রথমে স্থানীয় সম্পদ বা অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ করতেই হবে । এতে করেই পুঁজিবাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে হবে । তাছাড়া যদি কোনো দেশ বা তার কাঁচামাল বাইরে রপ্তানি করে তবে বুঝতে হবে সে দেশ বা অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাস্থ্যপ্রদ নয় । দৃষ্টান্তস্বরূপ, ত্রিপুরা থেকে রপ্তানিকৃত প্রধান অর্থকরী কাঁচামাল রাবার । সর্বোপরি, বিশ্বজুড়ে এখন যে অর্থনৈতিক কাঠামো রয়েছে তা পুরোপুরি খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে । গড়ে তুলতে হবে সম্পূর্ণ নোতুন ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো । পুঁজিবাদীদের হাত থেকে আমাদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে । সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের সার্বিক সমস্যা সমাধানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করা দরকার । তবেই রাজ্য থেকে দেশ ও বিশ্বে সার্বিক সমস্যা সহ জটিল সমস্যার সমাধান পুরোপুরি ভাবে অবশ্যই সম্ভব। মনে রাখা দরকার, অন্যের কোলে পিঠে চড়ে নিজের আসল শক্তির পরিচয় হয় না নিজের পায়ে চলাতেই আপন শক্তি প্রমাণিত হয় । আর তার জন্যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সমূলে পতন ঘটাতে আরেকটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রামে নামতে হবেই । এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই ।
লেখক পরিচিতি - লেখক শ্রী রঞ্জিৎ বিশ্বাস, জন্ম গ্রহণ করেন ১৫/০৪/ ১৯৯৩ ইং তথা বাংলা পয়লা বৈশাখ ত্রিপুরার এক প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিণ চড়িলামের এক নিত্যান্ত আর্থিক ভাবে দরিদ্র সাধারণ পরিবারে আমার জন্ম । পিতা শ্রী অরুণ বিশ্বাস ও মাতা শ্রীমতি অঞ্জু বিশ্বাস'র একমাত্র পুত্র । আর্থিক দারিদ্র্যের মধ্যেই পুঁথিগত বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে । বর্তমানে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় জড়িত ও গৃহ শিক্ষকতাই একমাত্র উপার্জনের রাস্তা । তিনি বইপোকা মানুষ । অজানাকে জানা ও জানাকে আরো গভীর ভাবে জানা তাঁর নেশা । নান্দনিক জগতে গান, কবিতা, নাটক, অভিনয়, সঞ্চালন ইত্যাদি করতে অন্তর থেকে ভালোবাসে । উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ জীবনে রাজ্য স্তরীয় বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি নব্য-মানবতাবাদী, প্রাউটবাদী, প্রতিবাদী ও বাস্তববাদী । নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম যে জাতির সেই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে কিছু করে যেতে কর্মে রত । আর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এর জন্যেই কাজ করে যেতে চান । সর্বোপরি তাঁর একটাই লক্ষ্য একটা অখন্ড আদর্শ মানুষের সমাজ গঠিত হোক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন