সুপর্ণা মজুমদার
--------------------------
"জীবনের পরপার থেকে রবীন্দ্রনাথ বলছি------হ্যাঁ, তোমাদের হৃদয়ের কবি রবী ঠাকুর । তোমরা আজ আমার জন্মদিন পালন করেছো, আমার গুণ গান গাইছো,আমার জয়ধ্বনি করছো? ।আমার রচিত গান, কবিতা, নাটক সবকিছুতে তোমরা আজ বিভোর হয়ে আছো। আচ্ছা, একটা কথা বড় জানতে ইচ্ছে করে, তোমাদের মনে আমি কি শুধুই আমার জন্মদিন আর মৃত্যুদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ? তোমরাই তো বলো আমি তোমাদের প্রাণের কবি, মনের কবি। সত্যিই কি আমাকে তোমাদের হৃদয়ে আপাদমস্তক স্থান দিতে পেরেছো? নাকি লোক দেখানো ভরং!! জানো! সত্যিই ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। আমার জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে দুটো গান গাইলেই কি আমাকে হৃদয়ের কবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায় ? একবার নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করো। কতটুকু জানো তোমরা আমাকে ? হয়তো তোমাদের মাঝে মুষ্টিমেয় কারো বসার ঘরের আলমারিতে শোভা পায় আমার সৃষ্টি সম্ভার। কতটুকু জানো আমার সাহিত্য- দর্শন সম্পর্কে, যার উপর ভিত্তি করে বলতে পার আমি তোমাদের আত্মায় মিশে আছি ? বছরের তিনশো পয়ষট্টি দিনের শুধুমাত্র দুটো দিনকে বাদ দিলে আর কতদিন আমাকে মনে করো,আমার ভাবনায় ভাবিত হও? আমার চিন্তনের অংশীদার হও? বলো....!
জানো, কখনো বিদ্রূপহাসি পায়,আমি আমার সৃষ্টিকার্যের জন্য বিশ্বকবি আখ্যা পেয়েছি ঠিক, কিন্তু আমার সর্বপ্রথম পরিচয় আমি একজন বাঙালী । আমি বাংলার কবি, বাংলার সাহিত্যিক,বাংলার দার্শনিক । কিন্তু যাদের জন্য সর্বপ্রথম এই বিশাল সৃষ্টি, সেই বাঙালীরাই আমাকে ভুলতে বসেছে । শুধু আমাকে নয়, ভুলতে বসেছে এই বাংলার গর্ব পঞ্চ কবি, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল,সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। এমনকি বাংলা হরফের স্রস্টা ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর,সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, সবাইকে আজ বাঙালীরা ভুলতে বসেছে।
হে হে (বিদ্রূপ হেসে), অবশ্য হবে নাইবা কেন, এ-যুগের বাঙালী প্রজন্ম যে বাংলা ভাষাকেই ভুলতে বসেছে !! ভিন্ ভাষার বলয়ের আবর্তে ভেসে গিয়ে নিজের ভাষাকে অচ্ছুৎ করে দিয়েছে । ভিন্ ভাষাকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরেছে নিজেরই মায়ের মতো,আর তাতে এ যুগের বাবা-মায়েরা হচ্ছো গর্বিত । ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালী ছাড়া সমগ্র বাঙালী প্রজন্ম বাংলা ভাষা ভুলতে ভুলতে নিজের মা-কেই ভুলে গেছে । কিন্তু এই ভাবধারার জন্য এই প্রজন্ম দায়ী নয়, দায়ী তোমারা,বাবা-মায়েরা । তোমাদের উৎসাহে আজ বাংলা ভাষা, বাংলা হরফ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে । তোমাদের এতটুকু বিবেকে বাঁধে না। অথচ জানো,আমাদের এই বাংলা ভাষাটাই হচ্ছে বিশ্বের সবচাইতে মধুরতম ভাষা । ভিন্ ভাষাকে স্বাগত জানানোর মানে কি নিজের মাতৃভাষাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া? তাকে বিসর্জন দেওয়া? আসলে তোমরা বড়োই অনুকরণপ্রিয়, যা অন্য কোন জাতির মাঝে লক্ষ্য করা যায় না । এই অনুকরণ প্রিয়তার কারণে তোমাদের নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলেছো, যা খুবই দুঃখ জনক ।
এই প্রজন্ম ক'জন জানে আমাকে,নজরুলকে,কান্ত কবিকে? হয়তো একদিন এমন আসবে আমরা ওদের কাছে একটা অজানা অচেনা জগৎ হিসেবে পরিচিত হবো। বিশ্বাস করো, এটা ভাবতেই হৃদয় ভীষণ বিষন্ন হয়। আমি যে সত্যিই তোমাদের হৃদয়ে স্থান পেতে চাই, তোমাদের আত্মার সাথে মিশে যেতে চাই। মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালীর হৃদয়ে নয়, আপামর বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেতে চাই আমারই সৃষ্টির মাধ্যমে, আমারই আদর্শ, ভাবধারার মাধ্যমে । আমি চেয়েছিলাম আমার জাতির মানুষের হাত ধরে বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছাবো । তাই তো শান্তিনিকেতনের ভাবনা জেগেছিল আমার অন্তরে। আমি চেয়েছিলাম বাঙালী জাতির সাথে বিশ্ববাসী আমাকে চিনুক, আমাকে জানুক বিশ্বভারতীর সুবিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমি আমার কল্পনার সবটুকু নিছাড় করে দিয়েছি সেই প্রতিষ্ঠানের মাঝে ।
হে মহান বাঙালী জাতি, তোমাদের কবিগুরুকে যদি সত্যিই অন্তর দিয়ে ভালোবাস, সত্যিই যদি আমি তোমাদের প্রাণের কবি হই,নিজেদের শ্রুতিমধুর মাতৃভাষাকে হেয় করো না। হেয় করো না বাংলার কোনো কবি, সাহিত্যিক, মনীষীদের, যারা তোমাদের জীবন পথের পরিচয় বাহক। হেয় করো না বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিকে,ইতিহাসকে। বাইরের পৃথিবীর মাঝে নিজের ভাষাকে নিজের "মা"ভেবে যোগ্য সম্মানটুকু দাও। কে জানে, হয়তো তোমাদের হাত ধরেই আপামর বাঙালি আর বাংলা ভাষা বিশ্বের আঙ্গিনায় ধ্রুব তারার মতো জ্বলজ্বল করবে ! সেদিন আমি, তোমাদের রবী ঠাকুর ভাববো সত্যিই তোমরা আমাকে তোমাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছো। সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো,যেদিন সত্যিই তোমাদের মননে আর চিন্তনের গভীরে আমাকে ঠাঁই দেবে প্রাত্যহিক জীবনে নুতন প্রজন্মকে আমার সৃষ্টির সাথে, আমার ভাবধারার সাথে একাত্ম করে । আার যদি না দাও, যাকে তোমরা বলছো প্রাণের কবি, মনের কবি, হৃদয়ের কবি রবিঠাকুর..., সে একদিন অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে । আমি আশাবাদী তোমরা প্রাণের কবিকে হারিয়ে যেতে দেবে না।
আমি তোমাদের প্রতিটি স্পর্শ পেতে চাই । তোমাদের স্পর্শ পেতে মন যে সদা ব্যাকুল হয়!!
-----------*********-------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন