মন-চেতনার স্বরূপ পরিচিতি

     সত্যব্রত সাহা
   
 মানব অস্তিত্ব ত্রিসত্তা ভিত্তিকঃ (এক) পাঞ্চভৌতিক শরীর (physical body), (দুই) মন (Mind), (তিন) আত্মা বা চৈতন্যসত্তা (Consciousness) — এই তিনে মিলে মানব অস্তিত্ব ৷ এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান, একের অনুপস্থিতিতে অন্যের অস্তিত্ব বিপর্যয় ঘটে যায় ৷ আমরা নির্দ্বিধায় মন-চেতনার বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করে নিই ৷ কিন্তু এদের উৎপত্তির উৎস বা কারণ নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অাছে ৷ 

জড়বাদীরা বলে থাকে— মন ও চেতনা মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়াজাত উৎপন্ন সত্তা ৷ কারো মতে— মনের স্বরূপ হচ্ছে চেতনা ৷ কারো মতে— মন ও চেতনা  অভিন্ন সত্তা ৷ আবার কারো মতে— মন ও চেতনা ভিন্ন তথা পৃথক সত্তা ৷
************************************
© মন-চেতনার মনোবিজ্ঞান জাত ধারণাঃ মনতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে মুলতঃ প্লেটো, এরিস্টটল ও অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকদের সময়কাল থেকে ৷ মনতত্ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন — ডেকার্তে, লাইবনিজ, লক, বার্কলে, হিউম, কান্ট, হেগেল,  শোপেনহেওর, ফ্রয়েড ও ক্লামার্স প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য দার্শনিকগণ ৷
************************************
© মনোবিজ্ঞানে মনের সংজ্ঞাঃ মনোবিদদের মতে মনের যথার্থ সংজ্ঞা (definition) দেওয়া সম্ভব নয় ৷ তারা বলে থাকেন— বুদ্ধি ও বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ হচ্ছে মন, যা চিন্তন (thinking), অনুভূতি (feeling) ও ইচ্ছা (willing)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয় ৷ মন হল সেই সত্তা, যা আবেগ ও কল্পনার জনক ৷
************************************
© জড়বাদী দার্শনিকদের মতবাদঃ তাঁরা বলেন— মানসিক প্রবৃত্তি তথা ক্রিয়াকাণ্ডের কোনটাই শরীর থেকে ভিন্ন নয় অর্থাৎ মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই মন ও চেতনা নামক সূক্ষ্ম সত্তাদ্বয়ের জন্ম হয়ে থাকে ৷ সুতরাং দেহের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই মন-চেতনা ধ্বংস হয়ে যায় ৷

দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও  সাংস্কৃতিক চর্চা প্রভৃতি  কার্যাবলী মন সংক্রান্ত ব্যাপার ৷ এছাড়া প্রেমপ্রীতি, স্নেহ, ভালবাসা, মমতা ও প্রশান্তি, ষড়রিপু প্রভৃতিও মন সংক্রান্ত ব্যাপার ৷ দেহ সংক্রান্ত জৈবিক চাহিদা পূরণের পর মানসিক চাহিদা পূরণের দিকে মানুষ ধাবিত হতে থাকে ৷ অর্থাৎ যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র ব্যাপকভাবে রয়েছে সেখানে সঙ্গীতচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতি জনিত মানসিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পালিত হতে পারে না ৷ দেহের রোগের ন্যায় মনেরও রোগ হয়ে থাকে, যাকে বলা হয়— 'মানসিক রোগ' ৷ অতএব দেহ ও মনের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হচ্ছে ৷
************************************
© মনের প্রকৃত উৎস কি মস্তিষ্কঃ মনের উৎস দেহ তথা মস্তিষ্ক মনে হলেও মনের প্রকৃত উৎস মস্তিষ্ক নয়, মন দেহ থেকে ভিন্ন এক সূক্ষ্মতর (subtler) সত্তা, যার প্রকৃত উৎস হচ্ছে চৈতন্যসত্তা ৷ ঘটনাটিকে বুঝতে হবে উক্ত যুক্তির মাধ্যমে অর্থাৎ " না থেকে হ্যাঁ-এর উৎপত্তি হতে পারে না (i.e. from nothing something can not be created) ৷" তার মানে জড়সত্তা দেহতত্ত্বের মধ্যে 'মন' পূর্ব থেকেই অব্যক্ত অবস্থায় বিরাজিত ছিল, অনুকূল পরিবেশে তা দেহমধ্যে ব্যক্ত হল মাত্র  অর্থাৎ জড়বস্তু (matter)  থেকে মনের উৎপত্তি হয়েছে, একথাটিও সত্য ৷
************************************
© আনন্দমার্গ দর্শনে মন ও চেতনার সংজ্ঞাঃ দর্শন বিচারে— জড়বস্তু পঞ্চ স্তরাত্মক ৷ তন্মধ্যে জড়বস্তুর সুক্ষ্মতম স্তরটির নাম—  আকাশতত্ত্ব বা ব্যোমতত্ত্ব (etherial entity) ৷ এর চেয়ে সূক্ষ্মতর সত্তার নাম— 'মন' (i.e. the entity which is finer or subtler than the etherial entity is called 'Mind') ৷ আর মনের চেয়ে সূক্ষ্মতর সত্তার নাম হচ্ছে— 'চেতনা বা চৈতন্' (i.e. the entity which is finer or subtler than mind is called 'Consciousness') ৷ অতএব সৃষ্টির মধ্যে যেহেতু চেতনার চেয়ে কোন সূক্ষ্মতর সত্তার সন্ধান নেই, সেহেতু ভারতীয় দর্শনবিচারে 'চেতনা বা চৈতন্য' সত্তাকেই জগতের চরম উৎস বলে মেনে নেওয়া হয়েছে ৷  'পুরুষ' শব্দ নাম দিয়ে এই চৈতন্যসত্তার গুণকীর্ত্তন শুরু করা হয়েছিল ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৷ এই চৈতন্যসত্তা বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ— দু'টি অবস্থায় বিরাজমান ৷ আনন্দমার্গ দর্শনে  বিশুদ্ধ চৈতন্যসত্তার দার্শনিক নামকরণ করা  হয়েছে— " নির্গুণ পুরুষ বা শিব বা চিতিশক্তি" (Cognitive faculty) ৷ এই 'পুরুষ' তত্ত্ব হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির একম্ অদ্বিতীয়ম্ চরম মৌল সত্তা (Noumenal entity) ৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন