যুব মানসে বিবেকানন্দ


 ✍️প্রীতম পাল 


“ বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়;
অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির সাধ,
হে মহানন্দ ময়। ”
          — কবির একথাটির সাথে বিবেকানন্দের চরিত্রটি মিলেমিশে একাকার। বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলতে গেলে মনে হয় তিনি হাজারো-লক্ষ-কোটি মানুষের সুখ দুঃখের যেন এক চিরকালের সাথী। পৃথিবীর ইতিহাসে এ যেন এক সর্বত্যাগী, সর্বমঙ্গলাকাঙ্খী, যেন এক মহাজ্ঞানী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব; যিনি আসমুদ্র হিমাচল বিশাল এই ভারতবর্ষ পদব্রজে পদব্রজী প্রত্যক্ষদর্শী।  যিনি উপনিষদের আধুনিক ভাষ্যকারদের মধ্যে এক অন্যতম মহৎ চিন্তানায়ক ।

          স্বামীজি সমগ্র ভারতবাসীকে এক অভয় মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন এবং ধর্ম, দর্শন ও ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে চিরাচরিত চিন্তাধারার পরিবর্তে নতুন চিন্তাধারার প্লাবন এনেছেন । চিরাচরিত লোকাচার, ধ্যান-ধারনা ও ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি এক অভিনব, অভূতপূর্ব, এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

          স্বামীজির চিন্তাধারায়- জ্ঞান, কর্ম, ধ্যান এবং ভক্তি - এই চারটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছে । তিনি বলেছেন, আমাদের চরিত্রগঠন ও প্রকাশের মূল চাবিকাঠি হল কর্ম এবং কেবলই কর্ম । গীতার অমোঘ বাণী —
“ कर्मण्येवाधिकारस्ते मा फलेषु कदाचन ।
मा कर्मफलहेतुर्भुर्मा ते संगोऽस्त्वकर्मणि ॥ ”

( কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥ )৪৭॥

          — অর্থাৎ মানুষের শুধু কর্মেই অধিকার আছে, কর্মফলে নয়। মানুষ নিজেকে যেন কর্মফলের হেতু মনে না করেন এবং নিজের স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও যেন আসক্ত না হয়।

          ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে অর্জুনকে যে কর্মযোগের রহস্যজ্ঞান দান করেছিলেন, স্বামীজি তার 'কর্মযোগ'  গ্রন্থে সেই কর্মযোগকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং কর্মযোগের কর্মকৌশলকে অতি সহজ ও সরলভাবে ব্যাখ্যা করে সাধারন মানুষের নিকট উত্থাপিত করেছেন। কর্মযোগ আমাদের জীবনে অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে, ব্যবহারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, আধ্যাত্মিক জীবনে আজও অপরিহার্য । স্বামীজির মতে গীতাই যে উপনিষদের ভাষা । কর্মই মহাশক্তিকে জাগিয়ে তোলার আঘাতস্বরূপ । গীতায় কথিত এই কর্মযোগকে স্বামীজি নিজ ব্যক্তিসত্বার দ্বারা তুলে ধরেছেন আমাদের নিকট এবং বলেছেন ফলাকাঙ্খা বর্জন করে কর্মসাধনাই হল নিষ্কাম কর্ম । এই প্রসঙ্গে গীতায় বলা হয়েছে — “ যোগস্থ কুরু কর্মানি সঙ্গং ত্যত্বা ধনঞ্জয় | সিদ্ধ অসিদ্ধ্য সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে ||” ৪৮/২ ।

          গীতাতে বর্ণিত এই উক্তিটির তাৎপর্য এইরূপ যে, কর্মের সিদ্ধি অসিদ্ধি, লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে সমমনোভাবাপন্ন হয়ে, উদাসীন হয়ে, নিরাসক্ত হয়ে, নিষ্কামভাবে, নিঃস্বার্থপরভাবে কর্ম করাই হল 'যোগ'। সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে যে সমস্ত বুদ্ধি তাকেই যোগ বলা হয়েছে। সিদ্ধিতে হর্ষোল্লাস, অসিদ্ধিতে বিষাদ - উভয়ই পরিত্যাগ করে কর্ম করতে হবে । এই কর্মযোগের অর্থটিকে কর্মযোগের কর্মকৌশল বা নৈপুন্যরূপে উল্লেখ করা হয়েছে গীতায় ।

          শ্রীকৃষ্ণ, হযরত মহম্মদ, বুদ্ধদেব, যীশু খ্রীষ্ট – এরা সকলেই স্বামীজীর দৃষ্টিতে মহান । তিনি এমন একজন মনীষীর সান্নিধ্যে আসেন যার যুগলবন্দী এক অভূতপূর্ব, এক অশ্রুত পূর্ব, এক অতুলনীয় ঘটনা অর্থাৎ রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ । বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের ভাবনায় উদ্ভূত হওয়া মানবজাতি তথাপি সমগ্র যুবসমাজের নিকট নিবেদিত প্রাণ ।

          রামকৃশ-পত্নী সারদা মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই স্বামীজি বিশ্বধর্ম মহা সম্মেলনে যোগদান করেন । সেখানে আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত স্বরূপটি তুলে ধরার মধ্য দিয়েই সর্বত বিশ্ববাসিকে মুগ্ধ করেন অর্থাৎ তার মূল কথাই ছিল মানবাত্মার জয়গান ; তার মতে আমরা একই ঈশ্বরের সন্তান।

           ভারতের নবজাগরণের মূল চাবিকাঠি হল দেশের, সমাজের তথাপি সমস্ত ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেকের সেবা । স্বামীজির প্রত্যেকটি বাণিতেই যুবশক্তিকে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করার উপদেশ লুকায়িত রয়েছে । তিনি এই ভারত বর্ষকে আমাদের মহান মাতৃভারত হিসাবে গণ্য করেন। এই ভারতবর্ষই হল আমাদের দেবতা, আমাদের ঈশ্বর সব । অন্য সকল নিরর্থক দেবতারা আমাদের মন থেকে অদৃশ্য হয়ে থাক ; কিন্তু এই ভারত বর্ষই একমাত্র ঈশ্বর, আমাদের একমাত্র জাতি যিনি আমাদের ধারণ করে আছেন । এই ঈশ্বর সেবা একমাত্র যুবসমাজই পারে অক্ষত রাখতে । এই দেশের প্রতিটি জীব-জন্তু, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি গাছপালা সহ সমস্ত উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকূলকে এবং সর্বোপরি আমাদের মাতৃভূমিকে আমাদেরকেই যুবশক্তির প্রতিনিধিরূপ পূজন করতে হবে। স্বামীজি বলেছেন আমাদের একে অপরের প্রতি হিংস্র হওয়ার পরিবর্তে উপাসনা করতে হবে। 

          স্বামীজি বলেছিলেন, যা আমাদের তথাপি সমগ্র যুবশক্তির নিকট সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য অঙ্গ , যার জন্য আমরা ভুগছি এবং যা এখনও আমাদের চোখ খুলে দিচ্ছে না, তা হল সঠিক শিক্ষা। তিনি দেশের যুবসমাজকে দেশের সঠিক শিক্ষা প্রদানের আহ্বান জানান।

          স্বামীজি জাতি-গঠনের জন্য সমগ্র যুবসমাজকে তাদের আদর্শ স্থাপন করতে বলেন। বর্তমানে উত্তর- স্বাধীনতাকালে জাতি-গঠনের জন্য যুবসমাজকে উদ্যমী হতে হবে। সমগ্র দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বি শেষে সর্বোন্নতি বিধানের লক্ষ্যে যুবসমাজকেই ঝাপিয়ে পড়তে হবে। বর্তমানের সমগ্র যুবসমাজের ভেতর ভগৎ সিং থেকে সুভাষচন্দ্রের মতো দেশভক্তি জাগ্রত করতে হবে। 

          যুবশক্তিকে শুধু অর্থোপার্জন নয়, সমাজের সর্বসই এক আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করতে হবে, যে প্রদ্বীপ হবে অতলস্পর্শী সমুদ্রের ন্যায় অনুপম জ্ঞানের ভাণ্ডার । সে প্রদীপ কোনোদিন যাবে না নিভে ।

          স্বামীজি বলেছেন, এই যৌবন কালেই মানুষের শক্তি, উদ্যম এবং অসীম ক্ষমতা অর্জন করে। এ সময়েই যে, একজন মানুষের সৃজন ক্ষমতা সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষে পৌছায়। যুবমানস যে লক্ষাধিক হয়েও দেশের জাতির কর্মযজ্ঞে শামিল হয়ে জাতিকে যে কোনো প্রতিযোগিতার সম্মুখে স্বসম্মানে দাঁড় করাতে পারে। কিন্তু স্বামীজি প্রশ্ন করেছিলেন— “ আমরা কি বিশাল এই যুবশক্তির সাহায্যে দেশকে জগৎ সভার শ্রেষ্ঠ আসনে বসাবার উদ্যোগ নিয়েছি?” স্বামীজি আরও বলেন যে- এটাই হল সেই বয়স যখন মানুষ এক আদর্শ মানুষে পরিণত হতে চায় । তিনি এই ভারতবর্ষকে দ্বান্দ্বিকতার মাতৃভূমি বলেছিলেন। কারন একদিকে ভারতের এত সম্ভাবনা, এত সম্পদ আর অন্যদিকে এক-তৃতীয়াংশ ভারতবাসী এক বেলা আহার করেই কালাতিপাত করছে। ভারতবর্ষে এই নিরন্ন, দরিদ্র লোকের পাশে এই যুবসমাজকে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন স্বামীজি। যুবসমাজকে সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিকাঠামোগত ভারতের সর্বপ্রকারের উন্নয়নের জন্য তিনি আহ্বান জানান। এই সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিসরে কর্মোদ্দম, অতি মানবিক প্রচেষ্টা যা একমাত্র যুবসমাজই প্রদান করতে পারে। 

          বর্তমানে ভোগবাদের দুনিয়াম যুবসমাজ ভয়ংকরভাবে আধ্যাত্মিক দৈনতায় ভরপুর । এর থেকে যেন পরিত্রানের কোনো উপায়ই নেই। এজগ তের ব্যর্থতম প্রাণটিও বিবেকানন্দের চেতনার স্পর্শে রাঙা হয়ে উঠে। আজ বিবেকানন্দের দৈহিক উপস্থিতি নেই ঠিকই কিন্তু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক এবং আগামিরও পরিত্রাতা রূপে সবার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত থাকবে অক্ষয় রবির ন্যায়। তাঁর জন্মদিনের ধারাকে বহন করে আমরা একখানা মালা গ্রন্থন করবো। সে মালা যাবে না। ছিরে। সেই সুক্ষ্ম প্রেন্স পূর্ণ মালাখানি হবে যুবসমাজের কাছে মায়ের আশীর্বাদের ন্যায় এক দুর্লভ অনুভূতি।

          একটা নেশামুক্ত সমাজ তৈরী হয় যৌবনের হাত ধরেই। আর সেই যৌবনই যদি নেশার কবলে নিমজ্জ্বিত হয় তবে সে সমাজ ক্রমশ তমালয়ে তলিয়ে যাবে। তাহলে কে হবে আমাদের আলোর দিশারি ? 

          স্বামীজিই ভারতীয় কর্মবাদের সার্থক উত্তরসুরি । তিনি ভারতীয় দর্শনের ভাবধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন জগতে আমরা যতরকম কাজ দেখতে পাই, তা সবই চিন্তার প্রকাশ মাত্র। আমাদের নিরন্তর কর্ম করতে হবে। কিন্তু সেই কর্ম হবে আসক্তি শূন্য । তাই কবির গানের সুরে তাল মিলিয়ে যেন আমরাও গেয়ে উঠি – 
“ বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ।।”
          ‘কর্মের জন্য কর্ম’ করার কথাই স্বামীজি বলেছিলেন। স্বামীজির মতে-কোনো কর্মই তুচ্ছ নয়, ঘৃণ্য নয়; যার যেখানে কর্ম, তার সেখানে মুক্তি ।

          যুবসমাজের প্রতি স্বামীজির উপদেশ বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মানবের প্রত্যেক কর্মই উপাসনা, কারন মুক্তিলাভ করাই তার অন্তর্নিহিত ভাব এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সকল কর্মই সেই উদ্দেশ্যের অভিমুখে চলছে। স্বামীজি একটি বিদেশী পত্রিকার কথা বলেছিলেন যেখানে লেখা ছিল- সম্ভবত ভারতীয়রাই এমন একটি জাতি, যাদের মধ্যে বিপুল পরিমাণে নবযুবক বর্তমান। এই যুবসমাজ এতই উদ্যমী, এত সৃষ্টিশীল এবং এতই ক্ষমতাবান যে তারা ইচ্ছা করলেই সমগ্র বিশ্বজগতের নিকট বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে। 

          আজকের যুবসমাজ স্বামীজির প্রতিটি জন্মদিনে স্বপ্ন দেখে তিনি হলেন যৌবনের মূর্ত প্রতীক, তাইতো তার জন্মদিন 'যুবদিবস'। সেই স্বপ্ন হবে সুস্থ, সবল, কর্মতৎপর আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব চিন্তায় সমৃদ্ধ যুবসমাজের হাত ধরে এক প্রাণচঞ্চল সমাজ। বিবেকানন্দ ছিলেন, আছেন এবং অনন্তকাল ধরে যুবসমাজের অন্তরে বাহিরে থাকবেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন — “ পৃথিবীতে যখন এসেছিস, তখন একটা দাগ রেখে যা।" তিনি এই যুবসমাজের নিকট চেয়েছেন - “ যাতে চরিত্র তৈরী হয়, মনের শক্তি করে, বুদ্ধির বিকাশ হয়, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারে, এই রকম শিক্ষা চাই ।”
 
          যুবসমাজ গেয়ে উঠবে – “ওগো বাঁশিওয়ালা,বাজাও তোমার বাঁশি” । প্রত্যেকটি যুবকের অন্তরেই বেজে উঠবে সেই বাঁশির তান যে বাঁশির সুর মধুর সুরে গেয়ে উঠবে আপন গরিমায়। 

          স্বামীজি আমাদের হৃদয়ে চিরবিরাজমান। তাই রবীঠাকুরের কন্ঠে বলতে চাই —

“ নয়ন সম্মুখে তুমি নাই;
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই।”
রবিঠাকুরের কথাতেও স্বামীজির যুবসমাজের প্রতি আহ্বান প্রস্ফুটিত হয় --- “ স্বর্থমগ্ন যে জন বিমুখ, বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে ” ।
          প্রবন্ধটির পরিসমাপ্তিতে, রবীঠাকুরের কন্ঠে স্বামীজির প্রার্থনায় আমিও যুবসমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে এইরূপে প্রবন্ধটির সমাপ্তি ঘটাচ্ছি —
“ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে;
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। ”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন