✍️ প্রীতম ভট্টাচার্য
মৎস্যকন্যা শব্দটি শুনলেই সাগর পাড়ে শুয়ে থাকা কোনো রহস্যময়ী রূপসীর ছবি আমাদের কল্পনায় ভেসে উঠে। সাধারণ কোনো রমনী নয়, অর্ধেক তার মানব শরীর আর অর্ধেক মাছ। সেই আদিকাল থেকেই সুন্দরী, লাস্যময়ী, এমনকি কখনো বিশ্বাসঘাতক মৎস্যকন্যার চরিত্র ঘিরে জন্ম নিয়েছে বহু কিংবদন্তী। বহু মনের কল্পনা, গল্প, উপন্যাস ছাড়িয়ে বাস্তবেও মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছে এই প্রাণের উপস্থিতি। বহু নাবিক অন্তত একবার মৎস্যকন্যার দেখা পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর কাটিয়েছেন সমুদ্রের বুকে। অনেকে আবার এক দর্শনে পাগল হয়েছেন এমন গল্পও প্রচলিত আছে।
স্থানীয়রা তাকে তার হাত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের উপর উঠে আসতে দেখত। আবার সে পিছলে ঢেউয়ে মিলিয়ে যেত।তবে মানুষ দূর থেকে শুধুমাত্র কয়েক পলক তার দেখা পেত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রূপকথায় উপকথায় মৎসকন্যার বর্ননা পাওয়া যায়, যার মধ্যে দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া সবাই আছে।আমরা ছোটবেলায় জলপরীর অনেক গল্প শুনেছি। বাংলার জলপরীও আসলে মৎস্যকন্যাই। হাজারও গল্পের মাঝে কিছু কিছু গল্প আমরা এই বইয়ে জানব।
যেসব অঞ্চলের সভ্যতায় এদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি সেগুলো হচ্ছে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন অর্থাৎ সমগ্র পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, ভারতীয় উপমহাদেশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, আটলান্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ইত্যাদি।বলতে গেলে সারা পৃথিবী। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মারমেইডদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সাহিত্যে এদের সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন হল ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। ছোটবেলার হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথার গল্পে পড়া মৎস্যকন্যার কথা সবারই মনে থাকার কথা। ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত সৃষ্টি লিটল মারমেইডের গল্পও সবার জানা। এমনকি আধুনিক যুগেও মৎস্যকন্যাদের নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে ।যেমন এই বইটি। যেটি তোমরা এক্ষণ পড়ছ।
পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক সভ্যতার মিথোলজির দিক থেকে দুটো মিল আমাদের চোখে পরে ।হোক না সেই সভ্যতা মূল ইউরেশিয়ান ভূপৃষ্ঠ থেকে হাজার হাজার বছর ধরে বিচ্ছিন্ন, তবুও মহাপ্লাবন আর মৎসকন্যা বা মারমেডের মিথ সেখানকার মিথোলজিতে পাওয়া যাবে,হয়ত কিছু ব্যতিক্রম থাকবে ।মহাপ্লাবনের মিথের কথাই ধরা যাক, প্রাচীন সুমেরিয়দের “ইরিডু জেনেসিস”,প্রাচীন ব্যাবিলনে গিলগামেশের মহাকাব্যে বর্নিত মহাপ্লাবন,বাইবেলের নোয়ার আর্ক, গ্রীক পুরাণে বর্নিত তিনটি মহাপ্লাবন, আইরিশদের লেবর গ্যাবালা স্যাসার এর বর্নিত মহাপ্লাবন,নর্সদের বের্গেল্মির দানব আর মহাপ্লাবনের কাহিনি, মধ্য আমেরিকায় মায়ানদের ‘পোপোল ভূ’ তে বর্নিত মহাপ্লাবনের কাহিনি, দক্ষিণ আমেরিকার উনু পাচাকুটি বা (ভিরাকোচার অভিশাপে)লেক টিটিকাকায় মহাপ্লাবন, হাওয়াই মিথোলজির নু’উ আর মহাপ্লাবনের কাহিনি, হোপিদের উপকথায় ,মাউরি উপকথায় -মহাপ্লাবনের মিথ আছে পৃথিবীর সব সভ্যতার প্রান্তে ,ভারতীয় উপমহাদেশেই আছে তিন চারটে আলাদা মহাপ্লাবনের কাহিনি (তারমধ্যে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য হলো আন্দামানের আদিবাসীদের মিথটা ,যারা উপমহাদেশের মূল ভূপৃষ্ঠ থেকে হাজার হাজার বছর বিচ্ছিন্ন)।
সেই রকম মারমেড বা মৎসকন্যা জাতীয় প্রানীর মিথ,চিত্র বা দেওয়াল চিত্র কিংবা গুহাচিত্র গোটা পৃথিবীর সব সভ্যতার প্রান্তে প্রচলিত ,সেটা পেরুর কুসকোর প্রাচীন পাথুরে দেওয়ালে অঙ্কিত মারমেড রিলিফ হোক,বা প্রাচীন আসিরিয়ার উপকথা পুরানের দেবী আট্রাগেটিস,এমনকী আলেকজান্দারের বোন থেসালোনিকা , গ্রীক উপকথা মতে যে মরার আগে একটা মৎসকন্যায় রুপান্তর হয়।আরব্য রজনীর আবদুল্লাহর অদ্ভুত জলজগৎএ ভ্রমনের গল্প, বা ব্রিটেনের প্রাচীন উপকথায় ,যেখানে মৎসকন্যা অশুভ জিনিস,আবার সেই পশ্চিম ব্রিটেনের জেনোরের কোন এক গ্রামে,আটলান্টিকের তীরে,ম্যাথু নামে এক মানুষের সঙ্গে এক মৎসকন্যার প্রেম হয়, এই ভাবেই বিভিন্ন লোককথায় মৎসকন্যারা বেঁচে আছে ।
মৎসকন্যাদের নিয়ে প্রথম বর্ননা পাওয়া যায় প্রাচীন অ্যাসিরিয়াতে ১০০০ খিঃ পূঃ। এখানে বর্ননা থেকে জানা যায় দেবী অ্যাটারগাটিস ভুল করে যখন তার মানব প্রেমিক কে হত্যা করে ফেলেন, লজ্জায় দুঃখে জলে ঝাপঁ দেন আত্নহত্যা করার জন্য। কিন্তু দেবী অ্যাটারগাটিস এত সুন্দরী ছিলেন যে সমুদ্র দেবতা পসাইডন তাকে মৃত্যর রাজ্যে যেতে না দিয়ে অর্ধমানবী অর্ধমাছ রূপে নব জীবন দান করেন।
একই বর্ননা পাওয়া যায় ব্যাবিলনীয় উপকথায়। এখানে দেবী অ্যাটারগাটিস এর নাম বদলে হয় দেবী ‘ইয়া’। গ্রীক উপকথায় এই অ্যাটারগাটিসই আবার ‘আফ্রোদিতি’ নামে পরিচিত।কাহিনি মোটামুটি একই রকম। বিভিন্ন দেশের রূপকথায়, উপকথায় মৎস্যকন্যা দের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এরপর আসি মৎস্যপুরুষ ‘ইয়ার’ কথায়, মেসোপটেমিয়ায় তিনি পূজিত হতেন সমুদ্রের দেবতা, জ্ঞান, সৃষ্টি আর ম্যাজিকের দেবতা রূপে। তিনি বন্যার দেবতা এনিলিলের হাত থেকে রক্ষা করছেন মানব সভ্যতাকে। ব্যবিলনীয় মিথ অ্যাত্রাহাসিস আর তাদের মহাকাব্য গিলগামেষ অনুসারে মানুষদের চীৎকারে ঘুম নষ্ট হওয়ায় বন্যার দেবতা এনিলিল পুরো মানব সভ্যতাই ধ্বংস করতে চাইলে মারম্যান দেবতা ইয়াই তাদের রক্ষা করেন।
এরপর আসা যাক জাপানী উপকথায়। সেখানে আছে নিনগিও যে আসলে দৈত্যাকৃতি মাছ, যার শরীরের অর্ধেক মাছের আর অর্ধেক মানুষের মত কিন্তু মুখটি বানরের মত। ভয় না পেয়ে খাদ্যাভ্যাসে এই মাছকে রাখতে পারলে সৌন্দর্য আর চির যৌবন সুনিশ্চিত।
আফ্রিকান উপকথায় আছেন দেবী মামী ওয়াটা ইংরাজীতে মমি ওয়াটার, যার সুনজরে থাকলে প্রচুর সৌভাগ্যের অধিকারী আর কুনজরে থাকলে মাছে পরিণত হওয়া ভাগ্যে লেখা থাকবে।
আয়ারল্যান্ডের মৎস্য কন্যারা ভারী সুন্দরী আর একঢাল সবুজ চুলের অধিকারিনী। মৎস্যপুরুষরা যদিও সুন্দর নন কিন্তু এক অদ্ভুত ম্যাজিক টুপি পরেন যার নাম কোহুলিন ড্রুইথ যা তাদের জলের নীচে থাকতে সাহায্য করে।
রাশিয়ায় আছে রুশালকা নামে দয়ালু মৎস্যকন্যার কথা। যারা জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করেন কিন্তু সময় বিশেষে অত্যাচারিত মেয়েদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে দোষীকে জলে ডুবিয়ে মেরেও দেয়। নরওয়ে আর স্কটল্যান্ডে আছেন ‘ফিনফোক’ মৎস্যরমণীর দল যারা রৌপ্য প্রেমী আর মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখে।
ইনকাদের মাঝেও ছিলেন সেডনা নামে এক মৎস্যকন্যারূপী দেবী, যিনি সামুদ্রিক জন্তুদের রক্ষা করেন।
এছাড়া ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আর আমেরিকায় আছে সামুদ্রিক আত্মা লাসিরন যার উৎস ফ্রেঞ্চ শব্দ লা সিরেন অর্থ মৎস্যকন্যা।
সি জে এস থম্পসন, ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজের সার্জনদের প্রাক্তন কিউরেটর তাঁর ‘দ্য মিস্ট্রি এন্ড লোর অব মনস্টারস’ বইয়ে উল্লেখ করেন, অর্ধ-মানব এবং অর্ধ-মাছ আকৃতির জীবের অস্তিত্ব হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ছিল এবং ব্যাবিলনের যুগে দেবতা ওনেস, যিনি মাছ-দেবতা নামে পরিচিত; তার মাথায় একটি মুকুট এবং তার মুখে মানুষের মত দাড়ি ছিল কিন্তু কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত তিনি ছিলো একটি মাছের মতো।
গ্রিক পুরাণের দেবতা ত্রিটন, যিনি ছিলেন সমুদ্রের বার্তাবাহক তার পূজা করত সিনেমবল (একটি আফ্রো-ব্রাজিলীয় ধর্ম) সহ বিভিন্ন আধুনিক ধর্মের মানুষেরা। তিনিও ছিলেন অর্ধ-মানব এবং অর্ধ-মাছ আকৃতির।
আমাদের দেশের পৌরাণিক কাহিনিতে জানা যায় ভগবান বিষ্ণু সর্ব প্রথম মৎস্যঅবতার নিয়েছিলেন। বিভিন্ন মন্দির গাত্রে মৎস্য অবতারের যে ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়- অবতারের উপরের অংশ মানুষের আর নীচের অংশ মাছের মত।
বিভিন্ন দেশের সবগুলো রূপকথা ,উপকথা পড়ার পরে জানা যায় মৎসকন্যারা সংগীতে ভীষণ পারদর্শী, সুরের মায়াজাল সৃষ্টির মাধ্যমে তারা জাহাজের যাত্রীদের মৃত্যুর দিকে আকর্ষণ করত। তাদের গানের গলা এতই চমৎকার ছিল যে সেই গান নাবিকদের কানে পৌঁছালে নাবিকরা সেই দ্বীপের দিকেই ধাবমান হতো। ফলে সেই জাহাজ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে সাগরে পতিত হত সবাই।
অ্যাটারগাটিস এর মানব প্রেমের অনুকরনে মৎসকন্যারা এরপর ডুবে যাওয়া নাবিক দের তাদের প্রেম এর ডাকে সাড়া দেবার জন্য সাগরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে তাদের কাছে পৌছে যেত, হায় তারা বুজত না মানুষ যে জলের নীচে বেঁচে থাকতে পারে না। ফলস্বরূপ যখন মৎসকন্যারা জলের নীচে দিয়ে ডুবন্ত নাবিকদের উদ্ধার করে তাদের দ্বীপে নিয়ে আসত ততক্ষণে তারা মৃত্যু রাজ্যে পৌছে যেত।
কোন কোন উপকথায় এই মৎসকন্যারা মানুষদের প্রতি ভীষণ বিদ্বেষপূর্ণ আবার কোথাও কোথাও কোথাও প্রেমময়। তবে যাই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত নাবিকরা মারা যেত। হায়! ভালবাসলেও মৃত্যূ না বাসলেও মৃ্ত্যু। বিশ্বের একেক সংস্কৃতিতে রয়েছে মৎস্যকন্যার একেক রকমের সংস্করণ
তাদের তীক্ষ্ণ সুরেলা গান, অপার্থিব সৌন্দর্য এবং সামুদ্রিক জীবনধারা সব মানুষের অন্তরেই এক অজানা আকর্ষণের সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বহু শতাব্দী প্রাচীন কিংবদন্তী মৎস্যকন্যার দর্শন পাওয়া কি এই যুগেও সম্ভব? তবে কি তা শুধুই কল্পনা? নাকি সত্যি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন