✍️ কলমে - শ্যাম মালাকার
কাল পেপারে পড়েছিলাম এই প্রথম একজন নারী ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি হয়েছে । শুনে মন ভরে গেছিলো ,মন থেকে দ্রৌপদী মহাশয়া কে আমি অনেক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলাম । অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই মাননীয়া রাষ্ট্রপতি মহাশয়া কে । কিন্ত যত দিন যাচ্ছে খবরে ফেসবুক what's up, যেখানেই দেখছি আমার so call শিক্ষিত বন্ধুরা কয়েকটা পোস্টার নিয়ে বা কিছু লেখার মাধ্যমে তুলে ধরছে যে " ভারতের সর্বপ্রথম একজন আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি হয়েছে । " এ আমি কি দেখতে পাচ্ছি ? এই স্বাধীন ভারতে একটি স্বাধীন নাগরিক সর্বোপরি একজন স্বাধীন মানুষের পরিচয় তিনি কোন জাতির মানুষ ! আমি ভাবতেই পারছিনা যে তাদের মানসিকতা এত হীন । আজও পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার কাছে নারী পরাধীন হয়ে রয়েছে ।
এই কারণেই বেগম রোকেয়া আজও প্রাসঙ্গিক আমাদের কাছে । বেগম রোকেয়া অনুভব করেছিলেন, ধর্ম অনেকক্ষেত্রেই নারীকে দাবিয়ে রাখার এক অস্ত্র। তাইতো তিনি ধর্মের নামে নারীদের অবদমিত করে রাখার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন। তার মতিচূর উপন্যাসের স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে তিনি বলে গেছেন - যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”
কিন্তু এত বছর ধর্মের নামে আজও নারীদের অবরূদ্ধ করে রাখার প্রয়াস চালানো হয়। নারীর চলাফেরার ওপর এখনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মেয়েদের কাজ ঘরসংসার করা, তাদের অবস্থান অন্তঃপুরে— এমন কথা সমাজের অনেকই বিশ্বাস করে। উদার সমাজ, মুক্ত পরিবেশ আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। অবশ্য উদার ও মুক্ত সমাজ এমনি এমনি আসে না। তার জন্য আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন। এগিয়ে গিয়ে সেই প্রয়াস করতে হয় সমাজের অগ্রসরমান মানুষদেরই। কিন্তু এখানে আমাদের বিশেষ দুর্বলতা। নারী উন্নয়নে নারীদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজের সার্বিক পরিবর্তনে বর্তমান নারীদের অবস্থান কোথায়? এখন অনেক নারী লেখাপড়া শিখছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারছে। চাকরির পরীক্ষায় সফল হচ্ছে।
তবে কিনা— ওইটুকুই। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর নিজের সমাজের জন্য কাজ করার প্রয়াস কোথায়? আমার সমাজের প্রতি কর্তব্য অন্য সমাজের মানুষজন এসে করে দেবেন, এই ভাবনাই বোধহয় শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ভোগবাদী জীবনের প্যাঁচে আটকে চাকরি, সন্তানের ক্যারিয়ার, ভালো বাড়ি— এত কিছুর মধ্যে নিজেদের জংধরা সমাজ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
আপনাদের বলি দয়া করে জনজাতি, দলিত, সাঁওতাল শব্দ গুলো বার বার সব স্থানে প্রয়োগ করবেন না । মহাশয়া মূর্মু একজন ভারতীয় নাগরিক এটাই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় । এবং সর্বপরি তিনি একজন মানুষ । দয়া করে ST, SC , OBC উঁচু নীচু ভেদাভেদ করে এইভাবে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কে নীচু করবেন না 🙏
সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, রক্ত ঝরছে যখন পৃথিবীর নরম শরীর থেকে, তখন মধ্যযুগের বাংলার কবি ( বড়ু চণ্ডীদাস ) উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী। এই বাংলার কবি বিশ্বকে শুনিয়ে ছিলেন মানবতার অমর কবিতা।
আমরা তাঁরই উত্তরাধিকার। আমরা উত্তরাধিকার ‘চর্যাপদ’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’। পদ্মা, গঙ্গা, বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে সহস্র বছর ধরে যে মানুষের বসবাস, তাদের সংগ্রামী জীবনের উত্তরাধিকার আমরা। সে জীবন অবিভাজ্য মানুষের। সে জীবন শ্রম ও আনন্দের। শান্তি ও সমন্বয়ের। প্রকৃতি ও পুরানের সংশ্লেষে গঠিত। সেই জীবনের সংস্কৃতি সততই প্রেমের জয়গান গায়। জীবনের জয়গান গায়। যুগে যুগে মানবের কল্যাণ কামনায় গীত হয় সাম্যের গান। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের জীবন ও জাতিসত্তা নির্মাণের প্রধানতম নিয়ামক। সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বিলুপ্ত হয় মানবজীবন থেকে উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে।
মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের তীব্র তীক্ষ্ণ কবিতা, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ আমাদের এ কথা জানান দেয় যে এক কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিতেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। ১৯০৫-এর বাংলা ভাগের ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপিত হয়। স্বয়ং কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কবিগুরু রচনা করেন বাঙালি জাতিসত্তার প্রধানতম সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’সহ অমর সব সংগীত। সেই শিক্ষায় সব বৈরিতার মধ্যেও এ জাতি তার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বহাল রেখেছে।
হে বাঙালির সন্তানেরা আমি অনুরোধ করছি -
হে নবীন, হে নতুন প্রজন্মের মানুষ, মন থেকে এ গৌরব কখনো মুছে ফেলো না যে তোমাদের এক সমৃদ্ধ অতীত আছে। এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে বিশ্বমানব হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তোমাদের লালন, রবীন্দ্র, নজরুল আছে। তোমরা নূরলদীন আর সূর্যসেন-প্রীতিলতার , ক্ষুদিরাম , নেতাজী , রামমোহন , রোকেয়া বিদ্যাসাগর , বিবেকানন্দের উত্তরাধিকার। তোমরাই মাওলানা ভাসানী, মণি সিং ও বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার। তোমাদের হাতেই তো সকল শক্তি ন্যস্ত করেছে মহাকাল। জ্বলে ওঠো। ছিন্নভিন্ন করো বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদের হিংস্র থাবা।
আপনাদের বলি দয়া করে জনজাতি, দলিত, সাঁওতাল শব্দ গুলো বার বার সব স্থানে প্রয়োগ করবেন না । মহাশয়া মূর্মু একজন ভারতীয় নাগরিক এটাই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় । এবং সর্বপরি তিনি একজন মানুষ । দয়া করে ST, SC , OBC উঁচু নীচু ভেদাভেদ করে এইভাবে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কে নীচু করবেন না 🙏
দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলি নিনাদিত হোক বাঙালির চিরন্তন সাম্যের বাণী—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন