✍️ অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
নন্দীপুর গ্রাম, ঝুপড়ি বাসীদের গ্রাম। এটাই তাদের স্বর্গলোক। এ গ্রামের প্রতিটি লোক মনোময় রাজ্যের রাজা। মনের রাজত্ব দেখে হয়তো সবাই অবাক হবে। তাদের সহজ সরল মন সকলের দৃষ্টি করে আকর্ষণ। তাদের নুন আনতে পান্তা পুরায় , দুবেলা সেদ্ধ ভাত জুটা তাদের সৌভাগ্যের বিষয়। শিক্ষার আলো গ্রামের দেওয়াল ভেদ করে তাদের ঘরের দেওয়ায় পৌঁছাতে পারেনি। অশিক্ষিত বলে এই নয় যে তারা অভদ্র, তাদের নম্র ভদ্র আচার আচরণ সুশিক্ষিত সমাজকে হার মানায়। ওই গ্রামে কেউ অতিথি রূপে ঘুরতে গেলে সে নারায়ণ রূপে পূজিত হয়।
আমিও কোনো এক স্বপ্নলোকে ওই গ্রামে ঘুরে এসেছি। সেই গ্রামের ওই এক সহজ সরল মাটির মানুষ দরিদ্র ফল বিক্রেতার নাম প্রেমচাঁদ। চাঁদ টা শুধু তার নামেই শোভা পায়, ভাগ্যের দ্বার গোঁড়ায় তার কোনো হদিস মিলে না। ফুতপাতে ফল বিক্রি করে দু চার পয়সা যা পায় তাতেই তার উনুন জ্বলে। কতটা সংগ্রাম করে জীবন কাটাতে তা তাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলে বোঝা যায় না। শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তার হাসি মাখা মুখ দেখলে পরান জুড়িয়ে যায়। আমার জীবনে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, ভগবান কত টুকু শেখার সুযোগ দেবেন কে জানে। আমরা অনেক সময় টাকার অহংকারে অন্ধ হয়ে গরীব হত দরিদ্র ফুতপাতে থাকা ঝুপড়িবাসীদের পশু সুলভ আচরণ করি, তাদের আমরা মানুষ বলে গন্য করি না। তারই এক জ্বলন্ত দৃশ্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার স্মৃতির পাতায় যত্নে তুলে রাখা ঘটনাটি বিবৃত করার ক্ষুদ্র প্রয়াসে ব্রতী হয়েছি।
সেদিন মাঘ মাসের ১৩ তারিখ ১৪২০ বঙ্গাব্দ প্রেমচাঁদ সকাল সকাল পান্তা খেয়ে মালপত্তর গুছিয়ে তার রিকশা ভেনটি নিয়ে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত, সাথে রয়েছে রাত্রির ঘোর অমানিশার হাত থেকে বাঁচার জন্যএকটি আর্শি ভাঙা টর্চ লাইট, বুকভাটা রোদের জন্য একটি বড়ো ছাতা,পাশের একটি ছেঁড়া ব্যাগে রয়েছে দুপুরের ভাতের সুবন্দোবস্থ। সে পুরোপরি রওনা হওয়ার জন্য তৈরী, এমন সময় আমি গিয়ে তার বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। সে প্রায় অবাক, সব কাজ এক দিকে ফেলে হাসতে হাসতে আমায় জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল আর বলল সে আমার কি সেবা করতে পারে। তখন আমি বললাম আমি তোমার বাড়ীতে বসতে আসিনি, আমি এসেছি তোমার সাথে আজ বাজার যাবো বলে। সে তো আমার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা আর হাসতে হাসতে বলে চলো তাহলে। আমিও তার সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিন্তু পরে যা ঘটলো তা মোটেই এতটা সুবিধার নয়।
হঠাৎ একটা দামী ভি আই পি গাড়ী এলো, গাড়ী থেকে এক বড়লোক বাবু আর তার গিন্নী নামল , গিন্নী মানে বিয়ে হয় নি, পরে হলেও হতে পারে আর নাও হতে পারে। মানেটা বুঝলেন তো ভাবি গিন্নী / প্রেমিকা। তারা দুজন গাড়ীটা রাস্তার এক পাশে দ্বার করিয়ে সোজা আমাদের দিকে আসচ্ছিল, আমি ভাবলাম যাক আজকে প্রেমচাঁদ দার আসতে না আসতেই লক্ষীর দেখা পেয়ে গেলো। বড়লোক খদ্দের পেয়েছে ভালোই রোজগার হবে, কিন্তু তারা এসে বললো তারা ফল কিনতে আসেনি তারা পুরো ফল দোকান কিনতে এসেছে, আমরা দুইজনের চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করতে লাগলো।প্রেমচাঁদ দা বলল, কেন বাবু এত ফল বাড়ীতে কোনো বড়ো অনুষ্ঠান আছে নাকি। তখন বাবু বলে উঠলেন না তেমন কিছু নয়, আসলে আমরা ফটো শুট করতে গ্রামে এসেছি আমাদের বিয়ের প্রি ওডিং অ্যালবাম বানাবো তাই, প্রেমচাঁদ দা বড়বাবুর কথা কিছু না বুঝে হ্যাঁ করে তাকিয়ে রইল, আমি বুঝিয়ে বললাম তারা এখানে ফটো তুলতে এসেছে। প্রেমচাঁদ দা বললো ফটো তোলার সাথে ফলের কি সম্পর্ক। এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমিও জানতাম না। তখন বড় বাবু বলল আমরা আপনার ফল গুলি কিনে নিয়ে এগুলো মাটিতে ফেলে তার উপর বসে নানান পোজে ফটো তুলবো, একথা শুনে প্রেমচাঁদ দার মাথায় রক্ত উঠে গেল, তা সত্ত্বেও তিনি ঠান্ডা মাথায় বললেন বাবু আপনারা ধনী পয়সাওয়ালা তাই বলে এত গুলি নষ্ট করবেন ফটো তোলার জন্য। এটা তো হয় না, টাকা আছে বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন। এত টাকার গরম ভালো নয়। বড়লোক বাবু আর চুপ করে স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি রেগে বলে উঠলেন তুমি ফল বিক্রি করতে এসেছ ফল বিক্রি, তোমার কত টাকার দরকার তা আমরা দিচ্ছি । প্রেমচাঁদ দার একগুঁয়েমি অব্যয়, তিনি পুরো উল্টে গেলেন বললেন ফল বিক্রি করবেন ওই না তাদের কাছে।তিনি বললেন ফলগুলি আমার কাছে লক্ষী স্বরূপ, এগুলো পায়ের তলায় থাকার জিনিস নয়। তিনি চান ফল গুলি খেয়ে সবাই তৃপ্তি লাভ করুক
তখন বড়লোক বাবু রাগান্বিত হয়ে পুরো ফলের রিক্শা ভ্যানটি ধাক্কা মেরে ফেলেদিলেন আর মাটিতে গড়িয়ে পড়া ফলগুলি পায়ের জুতো দিয়ে পিষে দিলেন আর প্রেমচাঁদ দাদাকে অশিক্ষিত গাঁইয়্যা বোকা ছোটলোক বলে গালিগালাজ দিতে লাগল। বড়বাবু এত রাগান্বিত হয়ে গেলেন যে আমি না থাকলে বোধ হয় প্রেমচাঁদ দার মতো নিষ্পাপ সহজ সরল মাটির মানুষটির গায়ে তিনি হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। বয়সে কত ছোটো ছিলেন তারা প্রেমচাঁদ দা থেকে।
কিছু দিন পর জানতে পারলাম, বড়লোক বাবুটি হলেন আমাদের জেলা হাসপাতালে আসা নতুন ডাক্তার মহাশয় আর উনার গিন্নীটি ছিলেন আমাদেরই গ্রামের এক প্রসিদ্ধ স্কুলের শিক্ষিকা। এটাই কি শিক্ষার গুণ হওয়া উচিৎ। শুধু গাদা গাদা নম্বর নিয়ে বড়ো বড়ো চাকুরী পেয়ে টাকার পাহাড় গড়া যায় ঠিকই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না, তার জন্য আগে দরকার নম্র ভদ্র ব্যবহার অর্থাৎ নৈতিকতা ও মানবিকতাবোধ। কালের স্রোতের ধারা আমার জীবনে কত পরিবর্তন নিয়ে এলো, সময়ের ফেরে বদলে গেল সব কিছু কিন্তু আমার মনে চিরদিনের জন্য গেঁথে রইলো প্রেমদার টাকার গরম কথাটি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন