পোষ্য


             ✍️সুমিতা বর্ধন

বিনোদ বিহারী  পাল, ওনি  বাজে মালের দোকানের বেশ পুরনো ব্যবসায়ীই বলা যায়, তবে  সেই অর্থে বলতে গেলে ওনার বাবা পুলিন বিহারী পাল ছিলেন  সেই দেশ ভাগের আগে  বাংলাদেশের অনেক বড়  বাজে মালের ব্যবসায়ী। খুব কষ্ট করেছেন  নাকি  ওনি ছোট বেলা থেকে ।একটা সময় মহাজনদের ফাই ফরমাস খেটে ওনাদের গা-হাত-পা টিপে মন জয় করতেন। এমনকি মহাজনদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে, রাতের পর রাত জেগে মহাজনদের মাল পাহারা দিয়ে অর্থাৎ ওনাদের মন জয় করার জন্য যা যা করা দরকার সবই করেছেন শুধু একটু রোজগারের আশায়। আর তাতে  যা কিছু টাকা পয়সা পেতো সেগুলো জমিয়ে নিজের বুদ্ধি খরচ করে  একটু একটু করে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন । ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ায় মা ,ভাই, বোনদের নিয়ে পরেছিলেন অকুল সাগরে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করলেন  ,ব্যবসায় উন্নতি হতে শুরু করলো,  একটা সময় বাজারে এক এক করে পাঁচটা ভিট কিনে বাজে মালের দোকান সাজিয়ে বসলো আর ব্যবসায়ও তখন যেনো তুঙ্গে বৃহস্পতি। ঠিক তখনি লাগলো ভারত বাংলার ভয়ানক যুদ্ধ। একটা সময় পুলিন বিহারি বুঝতে পারছিলো বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসতে হবে , এদিকে এতো ব্যবসা। মনটা ক্রমেই ভারী হয়ে আসছিলো তাঁর কারন হিন্দু মুসলিম সব তো তাঁর আপনার জন। কাকে ছেড়ে যাবে কোথায় যাবে। মানুষ হিসাবে  পুলিন বিহারী   খুবই ভালো ছিলেন, সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হলো ওনি কখনোই হঠাৎ বড় লোক হওয়ার ফায়দা নেন নি। কিছু মানুষকে  দেখা যায়  একটু টাকা পয়সা বা নাম ডাক  হলে যেনো ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকে ওনাদের যেনো মাটিতে পা দিয়ে চলতেও  কষ্ট , কিন্তু পুলিন বিহারী সব সময় মাটি দিয়েই হাঁটতেন এক কথায় বলা যায় ওনি মাটির মানুষই ছিলেন আজীবন।  প্রাচুর্য্যের মধ্যে পড়ে কখনোই অহংকারী হয়ে উঠেন নি  তিনি। যাই হোক একটা সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা , যুদ্ধ  এসবের মধ্য দিয়ে জল গড়ালো অনেকটাই।  কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাঙ্গা-যুদ্ধ বা দেশ ভাগ  "হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই" এই সম্পর্কের ফাটল ধরাতে পারেনি। তথাপি রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে সেলিম মিঞা, মোক্তার আলী ভাইদের সহায়তা নিয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পুলিন বিহারিকে এপার বাংলায় চলে আসতে হলো। কিছু টাকা পয়সাও নিয়ে আসতে পারলো ওপার থেকে , আর সেগুলো দিয়ে আবার নতুন উদ্যোমে ব্যবসা শুরু করলো।
    সেই পুলিন বিহারীর তিন সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান হলো বিনোদ বিহারী। যথারীতি পুলিন বিহারী ব্যবসায় হাল ধরতে বিনোদ বিহারীকে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করতে লাগলো, তারপর একটা সময় পরে বাবার মুদি খানার গদি তাঁর হেফাজতেই গেলো, পুলিন বিহারী খুবই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন , তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে  তিন ছেলেকে ভিন্ন ভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিলেন যেনো বাপের অবর্তমানে ছেলেদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে কোন বিবাদ না বাঁধে। সেই সুবাদে বিনোদ বিহারী বাপের দোকানের দায়িত্ব পেলো। বাড়ির বড় ছেলে বিনোদ বিহারী একটু শৌখিন মানুষ ছিলেন , শখ বলতে পোষ্য পালনের শখ। তাই বাড়িতে তাঁর নানা রকমের পোষ্য ছিলো যেমন,  না না ধরনের পাখি, কুকুর , বিড়াল ।  একটু সহজ সরল কিন্তু ভালো এবং স্বচ্ছ মনের মানুষ ছিলেন বিনোদ বিহারী। ওনার বাড়িতে কোন অতিথী এলে না খেয়ে যেতে পারতেন না। যেমন ছিলেন বিনোদ তেমনি তাঁর স্ত্রী। অমায়িক এবং দয়ালু বলতে যা বোঝায়। সেই মানুষের যে পোষ্য পালার শখ সেটা সবার মতো আমিও জানি। সেই শখের মধ্যে কুকুর তাঁর খুব প্রিয় , বিনোদ স্বপ্ন দেখতো বড় বড় লোকেদের মতো সে ও বড়  লেব্রেডর , জার্মান সেপার্ড ,গোল্ডেন সেপার্ড,ডালমেশিয়ান  এর মতো বিলেতি কুকুরদের গলায় বেল্ট লাগিয়ে সে সকালে কিংবা বিকেলে ওয়াক করতে যাবে আর প্রভুভক্ত প্রাণীরা প্রভুর কথায় উঠা বসা করবে , সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে সে এই সব পোষ্য দের। প্রয়োজনে ট্রেনারও রাখবে। কিন্তু কথা হচ্ছে "শখ" আর 'শখ পূরণ করা" এই দুটোই হচ্ছে  সাধ আর সাধ্যের ব্যাপার।  বিনোদেরও হয়েছে টা ঠিক তাই। পাঠকরা হয়তো ভাবছেন সবই তো ঠিক ছিলো তবে সাধ পূরণ করতে বাঁধা টা কোথায়। তাহলে ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক। বিনোদের স্ত্রী রাই সুন্দরী  প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বাড়ির একমাত্র মেয়ে ছিলো। দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে এবং খুবই দয়ালু এবং সুন্দর মনের একজন মানুষ রাই এবং বিনোদের প্রতিও রয়েছে  তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা , ভালবাসা । বিনোদও ঠিক তাই যেনো "মেড ফর ইচ আদার"। সেই সরল মতি বউটিও  বিনোদের পোষ্য গুলিকেও খুব ভালোবাসে শুধু কুকুর ছাড়া।  কুকুরে রাই এর ভীষন ভয়।আর এনিয়েও একটা গল্প রয়েছে। রাই যখন খুব ছোট্ট তখন  মেয়ের আবদারে রাই এর বাবা মেয়েকে একটি বিলেতি কুকুর কিনে দেয়।  বড় সাধ করে নাম রেখেছিলো তোজো।  সেই তোজো কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য  ছিলো মন্টু মাস্টার।  সেই মন্টু মাস্টার ছিলেন একজন দক্ষ ট্রেনার , ওনি পুলিশ কুকুরদেরও ট্রেনিং দিতেন। সেই মোতাবেক মন্টু মাস্টারের কাছে তোজোও ক্রমে ক্রমে ট্রেনিংপ্রাপ্ত  একটি শিক্ষিত সারমেয় হয়ে উঠছিলো।  যারপরনাই তোজোর গ্রহনযোগ্যতা সকলের কাছে যেমন বেড়ে গেলো ঠিক তেমনি ট্রেনিংয়ের ঠেলায় বাড়ির লোক কিংবা যারা তোজোকে দেখতে আসতো সকলেই তোজোকে মানুষের পর্যায়ে ফেলার চেষ্টা করতো।  পাঠক বন্ধু বুঝলেন না তো ব্যাপারটা আচ্ছা তাহলে আমি একটু খোলসা করেই বলি। দেখুন মানুষ  শিক্ষায় উন্নতি করতে হলে একটার পর একটা ট্রেনিং দিয়ে যায় ,যাতে হাতে কলমে বা যে কোন বিষয়ে পাকা পোক্ত হয়ে উঠে ছাত্রটি। আর যত কাজ শিখবে তাঁর তত ডিমান্ড বাড়বে , ততই সে জীবনে উন্নতি করবে আর দশটা মানুষ থেকে ট্রেনিং।প্রাপ্ত মানুষটি একটু বেশিই বুঝবে বা জানবে সেটা আমাদের ধারণা শুধুই নয় এটাই সত্যি। যেহেতু তোজোও একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সারমেয় তবে সেও মানুষের মতো সব কিছু করতে পারবে অর্থাৎ আমজনতার মতো আমকুকুরদের থেকে সে অনেকটাই আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক কারন সে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে ।সেটা সেই বাড়ির লোকজনদের মনে গেঁথে গিয়ে গিয়েছিলো।  ফলে সারাদিন আর তোজোর বিশ্রাম নেই। তজো এটা করো, ওটা করো।  তুমি স্পেশাল কি কি করতে পারো   সেটা  দাদাকে দেখাও , দিদিকে দেখাও  বা যারা বেড়াতে এসেছে ঘরে ওদের দেখাও। আর সে বেচারি তো এই আধুনিক  শিক্ষার চাপে এক্কেবারে নাজেহাল।   একদিন হলো কি তোজোর খুব জোরে খিদে পেয়েছে, রাইএর মা ওকে খাবার দিয়েছে , আর সে দেখে তোজো মহা খুশি, কিন্তু বাঁধ সাধলো রাই , সে গো ধরলো তোজো আজ থেকে টেবিলে বসে খাবে। যেমন বলা তেমন কাজ, রাই তোজোর বাটি নিয়ে সোজা টেবিলে তুলে দিলো আর তোজোকে বোঝাতে লাগলো ,আজ থেকে তোজো বাবু হয়ে চেয়ার টেবিলে খাবে। কিন্তু তোজোর খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো, মনে মনে ভাবছিলো  ট্রেনিং এর ওপর আবার ট্রেনিং তাও আবার খিদের সময় , তোজো ভারী রেগে গেলো রাই এর ওপর। তোজো খুব গালি দিতে লাগলো রাইকে কিন্তু রাই কি আর বোঝার পাত্রী। সে তোজোকে খাবার টেবিলে ট্রেনিং  দিয়েই যাচ্ছে। একে তো ভর দুপুর ,তার মধ্যে গরমের দিন তারপর  খিদের সময় মাথা ঠিক রাখতে পারলো না তোজো । আর তোজো কেনো কেউই পারতো না। রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখাতে গিয়ে রাইকে দিলো খুব জোর  কামড়ে। রাই এর চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী। বাড়ির সবাই দৌড়ে এলো , হাত থেকে গল গল করে রক্ত ঝরছে সে এক যা তা অবস্থা। রাই তো প্রায় অজ্ঞান হওয়ার পথে।  চিল চিৎকারে পাড়া গরম। কিন্তু বেদম ভয় পেয়েছে রাই, তারপর মেজাজ খিঁচিয়ে যাওয়া তোজোর দাঁত বের করে ঘরঘরানীর দৃশ্যে যে কোন মানুষের পিলা চমকাবে এটা খুব স্বাভাবিক , সেখানে রাই এর অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছেন।সে এখন মুর্চ্ছা যায় তখন  মুর্চ্ছা যায়। সেই ভয়ংকর  পরিস্থিতির কথা রাই  আজ পর্যন্ত ভুলতে পারে নি। সে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। এই সে কারণে রাই সুন্দরী কুকুর দেখলেই একশ গজ দূরে পালায়।
  এদিকে বিনোদ বিহারী পশু প্রেমী , তারওপর কুকুর ভীষন ভালোবাসে। গলায় একটা বেল্ট পরিয়ে কুকুর নিয়ে সকাল সন্ধ্যা একটু ওয়াক করা কেমন একটা বনেদিয়ানা ব্যাপার বলে মনে হয়। তাই বিনোদের খুব ইচ্ছা একটা দামি কুকুর পোষে । কিন্তু বাঁধ সাধে তাঁর প্রিয়তমা রাইসুন্দরী। কুকুরে তাঁর যে আতংক। বিনোদ বিহারীর বাড়িতে কুকুর ছাড়া বাকি মোটামুটি সব পোষ্য ই আছে, হরেক রকম পাখি , নানান জাতের কবুতর, বিদেশি মুরগি , নানা রকমের হাঁস,  খরগোস এখন শুধু একটা দামি কুকুর চাই। যাকে নিয়ে বিনোদ সকাল সন্ধ্যা ঘুরবে আর  প্রভু ভক্ত  প্রিয় পোষ্যটি তাঁর পেছন পেছন ঘুরবে। আহা ভাবলেই  বিনোদের প্রাণ পাখি কেমন যেনো নেচে উঠে।  কতোদিন যে তাঁর এই প্রিয় পোষ্যটি স্বপ্নে তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙতেই পাশে রাই সুন্দরীর ঘুমন্ত মুখ খানা দেখলে বড় মায়া হয়। শিশুর মতো সরল মুখখানা। কতো দিন এমন হয়েছে কুকুর দেখে ভয়ে বিনোদকে জড়িয়ে ধরেছে। আর সবার সামনে সে কি অস্বস্থি তাঁর।কিন্তু কি আর করা যাবে। উল্টোটাও তো হতে পারতো মানে যে ভয় টা রাই এর সেটা তো বিনোদেরও হতে পারতো।  তখনো কি রাই কুকুরের জন্য বায়না ধরতো , কোনদিনই এটা করতো না রাই। কারন বিনোদকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে রাই।  তাই স্বামীর খারাপ লাগে এমন কাজ কখনোই রাই করে নি আর ভবিষ্যতেও করবে বলে মনে হয় না। রাই এর ভালবাসার সন্মানে একটা আক্ষেপ থাকুক না এই জীবনে  তাঁতে কি।  কিন্তু তারপরেও বিনোদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কুকুরের পরিবর্তে এমন কি পোষা যায় যাতে করে রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দিমাগ কা বাতি জ্বলে গেলো আর যেই ভাবা সেই কাজ,  বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা ছোট্ট বিড়াল ছানা  নিয়ে এলো , সেটাকেই বিনোদ কুকুরের মতো পালন করতে লাগলো আর সেই গল্প ও আজ প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো, বিনোদ যখন বিড়ালের গলায় বেল্ট পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় প্রাতঃভ্রমন বা সান্ধ্যভ্রমনে তখন কিন্তু কিছু লোক অবাক চোখে আজও তাকিয়ে থাকে। নিন্দুকেরা অবশ্য আড়ালে বলে কুকুরকে মানুষ বানাতে গিয়ে যা হলো এবার কিনা বিড়ালকে কুকুর বানানোর চেষ্টা চলছে। সাধু সাবধান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন